Showing posts with label ছোটোগল্প. Show all posts
Showing posts with label ছোটোগল্প. Show all posts

Sunday, 27 January 2019

অহন আমি রিশকা চালাই | ছোটোগল্প


"সওদি থাইকতে লাক লাক ট্যাকা কামাইছি আর অহন..."

মোবাইলের উপর থেকে চোখ ও আঙুল সরাই আমি। ফেসবুক থেকে মন ও মুখ ফিরিয়ে লোকটির কথায় মন দিই।

জিগ্যেস করি আমি, "কী বললেন?" 
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল লোকটি। বলতে থাকল, "সবই কপাল, সবই ভাইগ্য! সওদি থাইকতে বারোশ রিয়াল বেতন অইছিল আমার। আর অহন আমি রিশকা চালাই।" 

ব্যস্ত রাস্তায় রিকশা এগিয়ে চলছে। ভোরে দূষণের শহরে বইছে একটু স্বস্তির বাতাস। আমি বলি, "কিন্ত কেন? রিকশা চালান কেন?" 

লোকটির কপাল বেয়ে ঘাম চুইয়ে পড়ছে। বয়স তিরিশ নাকি চল্লিশ ঠাহর করা মুশকিল। বলতে থাকল রিকশাঅলা, "সবই পেরেমের লাইগা। বড্ড ভালাবাসছিলাম মাইয়াডারে..." 

আমি কৌতূহলী হই। মোবাইলটা পকেটে পুরি। গল্পটি শুনতে মগ্ন হই। 

"মাইয়াডার বয়স তহন ষোল্ল কিংবা সতারো। ভালাবাইসা বিয়া করছিলাম। বিয়া কইরাও ভালাবাসছিলাম। পাগলের মতন ভালাবাসতাম। বউয়ের আসি দেকলে অন্তরডা জুরাইয়া যাইতো।"
"তারপর?", জিগ্যেস করি আমি। 

" সউদি এক দোকানের ক্যাশিয়ার অইছিলাম। বারোশ রিয়াল বেতন। মা আমার অসুস্ত আছিল। তাই ব্যাক টাকা পাঠাইতাম বউয়ের একাউন্টে..." 

কেন জানি দীর্ঘশ্বাস বেরোয় আমার। বলে উঠি, "ওহ!" 

লোকটির চোখ তখন ছলছল করছে। "একদিন সর্বস্ব লইয়া পালাইলো হারামজাদি। এক পোলার আত ধইরা আমার ব্যাক টাকা পয়সা লইয়া পলাইয়া গেল। তারপর অনেক ইতিহাস অইয়া গেল। আর অহন? হুম, অহন আমি রিশকা চালাই..." 

গল্প ফুরোলো কিনা জানি না। তবে আমার রাস্তা ফুরোলো। ভাড়া দিতে গিয়ে ভালো করে তাকালাম লোকটির ঘর্মাক্ত মুখাবয়বের দিকে। বউ হারানোর বেদন লোকটির বয়স মনে হয় বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটা৷ 

লোকটি ভাড়া নিয়ে রিকশা চালিয়ে সামনে এগোতে থাকে। আমি লোকটির প্যাডেল মারা দেখতে থাকি। কত হাজার জনের কত হাজার কাহিনি লেখা আছে এইসব প্যাডেলে। 

ওয়াদুদ খান 
২৬ জানুয়ারি, ২০১৯ 
গুলিস্তান, ঢাকা

Thursday, 25 October 2018

ক্ষয় | একটি ট্রাজিক প্রেম ও অবক্ষয়ের কাহিনি | ৪ পর্ব



(এই গল্পটা যতবার পড়ি- ততবারই জলে চোখ ভিজে যায়।)

পর্ব-১
▬▬▬▬

আমি ইমরান। আমার বন্ধু রাজিব। ও দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি চটপটে। ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হবার পর। আমাদের কলেজের বাংলা স্যার ছিলেন খুবই আমোদে। মাঝে মাঝেই ক্লাশে হাসির কবিতা আবৃত্তি করতেন উনি। ছাত্রছাত্রীদেরকেও উৎসাহিত করতেন কবিতা লিখতে। বাংলা স্যারের ক্লাশে রাজিব নিজের লেখা একটা কবিতা পড়ে শোনালো-

এই কলেজে পড়ি আমি
আমি পঁচা ছাত্র
লেখাপড়া করি না
বই কিনেছি মাত্র।

স্যাররা আমায় গাধা বলে
আমি তাতে খুশি
স্যাররা যখন গরু বলে
তখন তাদের দুষি।

বলি, ‘গাধা সে তো ভালোই বড়ো
বুদ্ধি আছে কিছু
গরু সে তো মূর্খ বড়ো
বুঝে না তো কিছু।

আমি স্যার বুঝি কিছু’-
শুনে স্যার হাসে।
বলে, ‘তুই বুঝিস
ঘোড়ার ডিম জলে ভাসে।’

আমি বলি, ‘না, না স্যার,
ডিম পাড়ে না তো ঘোড়া।’
স্যার বলে, ‘বুঝিস ভালোই
পারিস না ক্যান পড়া?’

রাজিবের এই হাস্যরসে ভরা কবিতা শুনে ওকে ভীষণ ভালো লেগে যায় আমার। তারপর খুব কৌশলে ওর সাথে বন্ধুত্ব জমিয়ে ফেলি।  কিছু কিছু বন্ধু হয়- যাদের সাথে মিশে মানুষ নষ্ট হয়। আবার কিছু কিছু বন্ধু আছে যাদের সাথে মিশে ভালো হয়ে যায় অনেক ছেলে। রাজিব ছিল এমন একটা ছেলে যার প্রত্যেকটা দিকই ভালো লাগতো আমার। এবং ভালো হবার অনুপ্রেরণা পেতাম।

ওকে কখনোই প্রথম বেঞ্চে বসতে দেখিনি আমি। ও বসতো সবার পেছনে। এতটাই পেছনে বসতো যাতে কোনো টিচারের কথা ওর কানে না যায়। ক্লাশের একঘেয়ে পড়াশোনাকে বড্ড ঘৃণা করতো ও। ক্লাশ মিস করায় ও ছিল সবার সেরা। ওর কথা হলো-

প্রতিদিন একই নাটক।
শিক্ষকের হাতে থাকবে চক।
মুখে থাকবে বকবক।
অকারণেই স্যারের পা করবে ঠকঠক।
আর ছাত্রছাত্রীদের বুকটা করবে ধকধক।

ওর এইসব ছন্দ শুনে আমরা হেসে উঠতাম কককক করে।

ওর এই এলোমেলো স্বভাবের কারণেই হয়তো ওকে ভালো লাগতো বেশি। তবে মজার ব্যাপার হলো- কলেজের প্রতিটা পরীক্ষায় প্রথম হতো ও। এই ছেলেটা এত ভালো রেজাল্ট কীভাবে করছে- সেটা ছিল সবার কাছেই একটা বিস্ময়। কারণ, ওর হাতে গল্পের বই ছাড়া অন্য কোনো পড়ার বই তেমন একটা দেখা যেত না।

ওর মাথায় সব সময় দুষ্ট বুদ্ধি ভর করতো। প্রায় সকল টিচারকে নিয়েই ছন্দ বানাতো ও।  এইতো কিছু দিন আগে আমাদের কলেজে কাউসার নামে এক স্যার এলেন। স্যার দেখতে খুবই সুন্দর। লম্বাও যথেষ্ট। সমস্যা হলো উনার মাথার সামনের দিকটায় চুল একেবারেই নেই। এই স্যারের আরেকটি সমস্যা ছিল- কোনো ছাত্রী উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই- উনি প্রথমে উনার চশমাটা চোখ থেকে নামাবেন। তারপর রুমাল দিয়ে চশমার কাঁচটা পরিষ্কার করবেন কয়েকবার। শেষমেশ চশমাটা আবার নাকের ডগায় বসাবেন। তখন এটা বোঝা কঠিন হয়ে যায়- উনি চশমার ভেতর দিয়েই দেখছেন নাকি খালি চোখে দেখছেন।  রাজিব করল কি, এই স্যারকে নিয়েও একটা কবিতা বানিয়ে ফেলল-

কলেজে এলেন নতুন স্যার
নাম তার Cow Sir (কাউসার)
ছাত্রীরা সামনে এলেই উনি যান দমে
উনার চশমার পাওয়ার যায় কমে।
উনি তাই কাঁচ ঘষেন বারবার
নাম তার Cow Sir (কাউসার)
চেহারাটা স্যারের- কিন্তু একের
সবই তার ঠিকঠাক
শুধু ভুল করে- চুল খসে
মাথায় পড়েছে টাক............

ওর এই কবিতা শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতাম আমরা। তবে যে ব্যাপারটা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করতো সেটা হলো- ও কখনো মেয়েদের সাথে মিশতো না। মেয়েদের থেকে চারশত গজ দূরে থাকার চেষ্টা করতো ও। মনে হতো- এ ব্যাপারে একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হয়েছে। এতটা মেয়েবিমুখ ছেলে আমি কলেজে আর দেখিনি।

এটা বোধহয় চিরন্তন সত্যি একটা ব্যাপার- কলেজে যত মেয়েই থাকুক- দুই একজন মেয়ে থাকবে অপরূপ দেখতে। তাদের রূপের আগুনে ঝাপ দিয়ে ছাই হতে চাইবে অনেক ছেলেই। তেমন একটা মেয়ে ছিল- রিয়া তার নাম............

পর্ব-২
▬▬▬▬

আমি তো মাঝে মাঝেই মেয়েটার দিকে হা-করে তাকিয়ে থাকতাম। এতটা সময় ধরে হা-করে তাকিয়ে থাকতাম যে- একবার একটা মাছি ঢুকে গিয়েছিল আমার মুখের ভেতর। অথচ, রাজিবকে দেখেছি একেবারেই নির্বিকার। মনের ভুলেও তাকাতো না ওর দিকে। রাজিবকে দেখে খুব হিংসে লাগতো আমার। আমি কেন ওর মতো হতে পারি না?

আমি রিয়াকে প্রেমের একটা চিঠি দেবো ভাবছিলাম। সমস্যা হলো আমি ভালো ছাত্র নই। কোনো কিছুই গুছিয়ে লিখতে পারি না। প্রেমের অফার সংক্রান্ত চিঠির শুরুটা কেমন হবে তাই গবেষণা করলাম দুই রাত।

- পত্রের শুরুতে আমার সালাম নিবেন। -
পত্রের শুরুতে আমার ভালোবাসা নিবেন।
- পত্রের শুরুতে জানাই শুভেচ্ছা।
- পত্রের শুরুতে জানাই ইত্যাদি ইত্যাদি..................

কোনোভাবেই আর পেরে উঠছিলাম না। তাই বাধ্য হয়ে ছুটে যাই রাজিবের কাছে। বলি, “দোস্ত, আমাকে একটা চিঠি লিখে দে না? প্রেমের অফার রিলেটেড। কিছুতেই চিঠিটা গুছিয়ে আনতে পারছি না।”
- “কার কাছে দিবি এই চিঠি?”
- “রিয়াকে দেবো। জানিস তো ওকে দেখার পর থেকে আমার মাথা আর ঠিক নেই। জানি, ও হয়তো আমাকে ভালোবাসবে না। না বাসুক। নিজের ফিলিংসটা জানিয়ে রাখি। মরা শামুকে পা কাটতেও তো পারে, তাই না?”

অনেক অনুরোধের পর ও আমকে একটা চিঠি লিখে দিলো এরকম-

রিয়া,

আমার ফ্রেন্ড ইমরান তোমাকে খুব ভালোবাসে। সে সারাক্ষণ তোমার দিকে হা-করে তাকিয়ে থাকে। হা-করে তাকিয়ে থাকা হচ্ছে ভালোবাসার ‘হাহিপ্রকাশ’। ‘হাহিপ্রকাশ’ হচ্ছে বহিপ্রকাশের চেয়ে বেশি কিছু। তুমি যদি আমার বন্ধুটাকে ভালোবাসো- সেটা ভালো। আর যদি ভালো না বাসো- তবে সেটা আরো ভালো।

ইতি
রাজিব

চিঠিটার উত্তর রিয়া আমাকে দেয়নি। দিয়েছিল রাজিবকে। সেই চিঠিটা রাজিব আমাকে পড়তে দিয়েছিল। যাতে লেখা ছিল-

রাজিব, তুমি ভাবলে কী করে ইমরানের মতো গাধা টাইপের একটা ছেলেকে ভালোবাসবো আমি। ওর চেহারাটা সুন্দর। মনটাও হয়তো সুন্দর। কিন্তু ও তোমার মতো ইন্টিলিজেন্ট নয়। তবে আমি খুব লাকি যে- স্টুপিডটা তোমাকে দিয়ে চিঠিটা লিখিয়েছে। তুমি যে আসলেই অসাধারণ ব্রিলিয়ান্ট তার প্রমাণ ঐ ‘হাহিপ্রকাশ’ শব্দটা।  চিঠি যখন লিখতেই বসেছি তখন একটা সত্য স্বীকার করেই শেষ করব।

একথা মোটেই অসত্য নয় যে, অনেক ছেলেই আমার পেছনে ঘোরে। তবে তাদের কাউকেই আমার পছন্দ নয়। আমার ভালো লাগে তোমাকে। তোমার বুদ্ধিমত্তা, তোমার রেজাল্ট এবং দাড়ি শোভিত চাঁদের মতো মুখ- সবই আমাকে তীব্র আকর্ষণ করে।  তুমি আমাকে ভালোবাসো বা না বাসো দয়াকরে কখনো দাড়ি কাটবে না। দাড়ি কাটলে তোমাকে এত সুন্দর লাগবে না দেখতে। দাড়িওয়ালা ছেলে আমার আজন্ম অপছন্দের। তবে তোমাকে দেখার পর ধারণা পাল্টে গেল। কল্পনাতেও ছিল না দাড়িওয়ালা মানুষ এত সুন্দর দেখতে লাগতে পারে।

আই লাভ ইউ রাজিব।

ইতি
রিয়া

চিঠিটা পড়ে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। রাজিবের দিকে তাকিয়ে থাকি অনিমেষ। সত্যিই তো দাড়ি শোভিত রাজিবের মুখখানা চাঁদের চেয়েও বেশি সুন্দর। ভেবে দেখলাম- আমি যদি কোনো মেয়ে হতাম- অবশ্যই রাজিবকে ভালোবাসতাম। তাই রিয়াকে কোনো দোষ দিলাম না। মনটাও খারাপ করলাম না। বরং ভাবছিলাম- আজ থেকে আমিও দাড়ি রাখা শুরু করব। প্রেমের ক্ষেত্রে দাড়ি কোনো বাধা নয়।  রাজিব কিন্তু রিয়ার ডাকে সাড়া দেয়নি। ওই চিঠির উত্তরও সে দেয়নি রিয়াকে।

ভালোবাসাহীন এক অদ্ভুত জগতে রাজিবের সাথে বসবাসের চেষ্টা করলাম আমিও। দাড়িও রাখা শুরু করলাম। পড়া ধরলাম গল্পের বই।
দেখলাম সময় কেটে যাচ্ছে।
সময় কেটে যায়।
সময়ের নিয়মই এমন।

ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর আমরা দু’জনেই টাঙ্গাইল সা’দত কলেজে ভর্তি হই। ও অবশ্য জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটিতে ফিলোসফিতে চান্স পেয়েছিল। ওর মনমতো সাবজেক্ট না পাওয়ায় ভর্তি হয়নি ওখানে। আমি মনে মনে এমনটাই চেয়েছি যাতে ও অন্য কোথাও ভর্তি না হয়। দু’জনেই পড়া শুরু করলাম ইংলিশ লিটারেচার। ঢুকে গেলাম সাহিত্যের অনন্য এক জগতে।

সেকেন্ড ইয়ারে উঠবার পর নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। আমাদের একটা সাবজেক্ট ছিল যার নাম ‘রোম্যান্টক লিটারেচার’। শেলী, কীটস, বায়রন- ওদের কবিতা পড়ে এক অদ্ভুত রোম্যান্টকতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো মন। দেখলাম মনের দরজায় আর তালা মেরে রাখা যাচ্ছে না। চোখজোড়া আর কোনো বাধা মানছে না। প্রেমে পড়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার আদর্শ ছিল রাজিব। ওর হার না মানা স্বভাব তখনো ছিল।

ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল রাজিব। ওকে বন্ধু কিংবা প্রেমিক হিসেবে পেতে চেষ্টা করতো অনেক মেয়েই। কিন্তু পারেনি। ওর কথা হলো জীবনে ভালোবাসা যায় দু’টি মাত্র জিনিসকে- সেটা হলো- ‘বই এবং বউ’- এছাড়া আর কাউকে নয়।

পুরো কলেজ ক্যাম্পাসটা যখন ভালোবাসার স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল- তখন দেখলাম, ও একটা কবিতা টানিয়ে রেখেছে ওর পড়ার টেবিলের সামনের দেয়ালে। কবিতাটা এমন-

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে
ভালোবাসার সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিই।
ভেঙে গুড়িয়ে দিই-
শত শত প্রেমিকের রক্তে গড়া
ভালোবাসার টুইন টাওয়ার।

তারপর হব ইতিহাস।
হব ইতিহাস।

ভালোবাসার উপরে ওর এত ক্ষোভ কেন তা বুঝতে পারতাম না আমি। ওকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে শুধু বলতো-

পৃথিবীতে আসলেই
প্রেম বলে কিছু নেই।
আজ যে মোর কাল সে তোর।
আজ যে কাছে কাল সে দূর.........

ফোর্থ ইয়ারে পা দেওয়ার পর ওর মাঝে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। এই পরিবর্তন আমি কল্পনাতেও করার সাহস পাইনি...........

পর্ব-৩
▬▬▬▬

আমি থাকতাম উত্তরা হলে। আর ও থাকতো সিএম হলে। ওর সাথে দেখা হতো প্রায় প্রতিদিন। মাঝখানে সপ্তাহ খানিকের মতো ওর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না। ফোন করেও পাচ্ছিলাম না ওকে।  ওর সাথে দেখা হলো সেদিন। দেখি- দাড়িগুলো অনেক খাটো করে ফেলেছে ও। ওর চুলগুলো ছিল কাজী নজরুলের মতো বাবরী দোলানো। সেই চুলও আর আগের মতো নেই। অনেক খাটো করে ফেলেছে। ওকে দেখে আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল- ভুল দেখছি আমি।

আমি ওকে বললাম, “রাজিব, আমি তো ভাবতেই পারছি না- তুই এতটা বদলে গেছিস এই ক’টা দিনে। হঠাৎ বাউণ্ডুলে ভাবটা ছাড়ার কারণ কী? তবে এখনো তোকে দেখতে কিন্তু চমৎকারই লাগছে।”
রাজিব বলল, “আমি হেরে গেছি ইমরান। আজ এই চব্বিশটা বসন্ত শেষে বুঝলাম- ভালোবাসার শক্তি আদি অন্তহীন।”
আমার ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল অপার বিস্ময়ে।
- “মানে?”
- “মানে আমি প্রেমে পড়ে গেছি ইমরান।”
- “কার প্রেমে?” - “রিয়ার।”

দেখি, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাচ্ছে দ্রুত। সামনে দেখি সেই সোনালি সময়। রিয়া। যাকে প্রথম দেখে- সেই প্রথম যৌবনেই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। যাকে পটানোর চেষ্টা করেছিলাম বোকার মতো।
সেই মেয়েটি এখনো ভুলেনি রাজিবকে?
এও কী হয়!
এটা কি বিশ্বাস করা যায়?

বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম- রিয়া যদি সত্যিই রাজিবকে এখনো ভালোবেসে থাকে, তাহলে এই ভালোবাসা মেকি নয়। যেখানে একটি চিঠি লেখার যে সময়- সেই সময়ের ব্যাবধানে নারীর হৃদয় তিনবার বদলায়- সেখানে রিয়া প্রায় ছয়টি বছর ধরে ভালোবেসে চলেছে রাজিবকে।  ভালোবাসা বলতে একটা জিনিস এখনো তাহলে আছে?

হঠাৎই ভীষন মিথ্যে মনে হলো রাজিবেরই লেখা একটা কবিতার শেষাংশ-

আকাশের রঙের আগেই
নারীর মন বদলয়ায়।
এই আলতু ফালতু যুগে
ভালোবাসে কোন শালায়?

তারপরের দিনগুলো রাজিবের জন্যে হয়ে গেল রোমাঞ্চ জাগানিয়া। আমার প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে গেল বিবর্ণ। হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে- তাকিয়ে থাকতাম দিগন্ত পানে। এক অন্তহীন নিঃসঙ্গতা কুড়ে কুড়ে খেতো আমাকে।
শুধু জানতে ইচ্ছে করতো-
রাজিব, তুই ভালো আছিস তো?

তারপর খুব দ্রুত কিছু পরিবর্তন লক্ষ করলাম রাজিবের মাঝে। একদিন দেখলাম দাড়িগুলো পুরোপুরি কামিয়ে ফেলেছে ও। ফর্সা মুখটা মনে হয় আরো ফর্সা হয়ে বেরিয়ে এলো। অন্য একদিন দেখলাম জিম থেকে বেরিয়ে আসছে রাজিব। তারপর আরেকদিন ওকে দেখলাম জেন্টস পার্লারে।

প্রেমে পড়লে মানুষের মন বদলায় শুনেছি। শরীরের চামড়াগুলোও যে প্রলেপ দিয়ে, চেচেমুছে পরিষ্কার করতে হয়- রাজিবকে দেখে সেটা বুঝলাম।

বদলে গেল সময়।
বদলে গেল রাজিব।
আর এক গাল দাড়ি নিয়ে- নিজেকে ভুলে যাবার অন্তহীন প্রয়াসে- আমি ডুব দিলাম সাহিত্যের সাগরে।

পর্ব-৪
▬▬▬▬

প্রায় একটা বছর ওর সাথে আমার আর যোগাযোগ ছিল না। তখন আমি মাস্টার্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

একদিন সকাল বেলায় নাস্তা করতে যাব- এমন সময় দেখলাম- প্রায় আশি হাত দূরে এক কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে আছে। তবে অবাক হচ্ছিলাম- কাকতাড়ুয়াটা দেখতে ঠিক মানুষের মতোই। পরনে শার্ট, প্যান্ট এবং পায়ে জুতো পর্যন্ত। চিকন একটা বাঁশের উপর মানুষের মাথার মতো কি একটা গোল যেন বসানো ছিল। কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম- এটা কাকতাড়ুয়া নয়।
এ যে আমাদের সেই রাজিব।
কী হাল হয়েছে ওর!

নিজের চোখকে বিশ্বাস করা খুব কঠিন মনে হচ্ছিল। আমি রাজিবের হাতটা ধরলাম। তারপর বললাম, “তোর এই অবস্থা কেন? এমন তো ছিলি না তুই? শুকিয়ে একেবারে বাঁশের মতো চিকন হয়ে গেছিস।”
ও কিছু বলল না।
হয়তো ও কিছু বলতে পারল না।
আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে খুব দ্রুত সরে গেল ওখান থেকে।

আমি কোনো হিসেব মেলাতে পারলাম না। জীবনের কোনো হিসেবই মিলে না গাণিতিক নিয়মে।  এর ঠিক আঠারো দিনের মাথায় একটা চিঠি পেলাম রাজিবের।

ইমরান,

আমি শেষ হয়ে গেছি। এভাবে শেষ হয়ে যাব কখনো ভাবিনি রে। একটা ছোটোগল্পের মতো হঠাৎ শুরু আমার জীবনের। আর ছোটোগল্পের মতো তার হঠাৎই শেষ।  যে সত্যিটা আমি কাউকে বলিনি, এমনকি তোকেও নয়- আজ সেটা তোর কাছে বলব। আমি এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। আমাদের ঘরটা ছিল ছনের। ছোটোবেলায় দেখতাম- যখনই কোনো ঝড় হতো- আমাদের মনের সাথে সাথে ঘরটাও কাঁপতো থরথর করে। ক্লাশ সেভেনে পড়ার সময় জসিম উদদীন এর একটা কবিতা নকল করে কয়েকটি চরণ লিখেছিলাম এরকম-

তুমি যাবে, যাবে ভাই,
যাবে মোর সাথে
আমাদের কুঁড়ে ঘরে
যে ঘরে বৃষ্টি এলেই বৃষ্টি পড়ে।

এই সীমাহীন দারিদ্রতাই আমাকে দূরে রাখতো সবার কাছ থেকে। তাই ইচ্ছে করেই মেয়েদের সাথে মিশতাম না। আমার কেবলই মনে হতো- 'অর্থ (টাকা) ছাড়া কোনো কিছুরই অর্থ (মানে) নেই'।

হার না মানা এক স্বভাব ছিল আমার। তাই শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পড়াশোনা ছাড়িনি। সেই ক্লাশ সিক্স থেকে টিউশন করি আমি। যখন ক্লাশ নাইনে পড়তাম তখনই পড়াতাম ক্লাশ টেনের এক ছেলেকে। রিয়েলি, যথেষ্ট মেধাবী ছিলাম আমি।

তোর মতো আমারও একটা মন ছিল। কিন্তু সেই মনের দরজায় মস্ত এক তালা ঝুলিয়েছিলাম। কেননা, কারও ভালোবাসা পাবার যোগ্য আমি ছিলাম না। এই যান্ত্রিক পৃথিবীতে ভালোবাসা পেতে কিংবা দিতে বুক বোঝাই ভালোবাসা নয়, লাগে পকেট বোঝাই টাকা। কিন্তু নিজের এই অক্ষমতা, অযোগ্যতা কিংবা দারিদ্রতা কারো কাছে প্রকাশ করতে চাইতাম না আমি। তাই কৌশলে শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। সেটাই বোধহয় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার জীবনে।

কারো ভালোবাসা পাবো না বলেই হয়তো ভালোবাসার বিরুদ্ধে লেখালেখি করে মনের রাগ ঝাড়তাম আমি।  তারপরেও- আমার একটা মন ছিল। সেই মনটা মাঝে মাঝেই সন্তানশূন্য মায়ের বুকের মতো খা খা করতো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য।  তাই ছয়টি বছর পরেও যখন দেখলাম- একটা মেয়ে এখনো আমার পথ চেয়ে বসে আছে তখন সেই পথে হাঁটা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। যদিও জানতাম- এই পথটা মোটেই মসৃণ নয়। ভীষণ বন্ধুর। দুর্গম। বড়ো সচেতনভাবে ভুল জায়গায় ফুল দিলাম আমি।  ভালোবাসা পেয়ে বুঝলাম- ভালোবাসা ভালো নয়।

টানা একটা বছর ভালোবাসার জলে সাঁতার কেটে দেখলাম- এর কোনো কিনারা নেই। এ যে সীমাহীন। তাই তীরে এসেও তরী ভিড়ল না আমার।  ওরা যে এত বড়লোক- এটা ছিল অকল্পনীয়। ভেবেছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হবে ও। কিন্তু দেখলাম- তা নয়। ধনীর দুলালী। ওর বাবা মায়ের ধারণা আমি রিয়াকে পটিয়েছি 'রাজ্য ও রাজকন্যা' একসাথে পাবার আশায়।

ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল ভীষণ বড়লোক এক ছেলের সাথে। ছেলেটা জব করে জাতিসংঘের সচিবালয়ে। স্যালারি বাংলাদেশি টাকায় চার লক্ষ ত্রিশ হাজার।
এমনটা হয়েছিল কারণ রিয়াও তো কম সুন্দরী নয়।
এমন সুন্দর একটা মেয়ে ও!
ওর পাশে ঐ লোকটা আর টাকার পাহাড়টা চমৎকার মানায়।  ভালোবাসা তাই মুখ থুবড়ে পড়ে।
আমি নিজেকে সরিয়ে নিই। এই অযোগ্য, অপদার্থটাকে ওর পাশে একটুও মানায় না বলে।

বিয়ে হয়ে গেল রিয়ার। শুনেছি অনেক নাকি কেঁদেছিল সেদিন। একমাস পরে নাকি দেখা গেছে হাজব্যান্ডের সাথে হাসতে হাসতে শপিং করছে রিয়া।

নিজেকে তাহলে বদলাতে পেরেছে রিয়া?
অবাক লাগেনি আমার।

কিন্তু এই একটা বছরের অন্তহীন ভালোবাসা, কথা বলা, স্বপ্ন দেখা- সবই সারাটাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াতো আমাকে।  ওকে ভুলে যাবার অদম্য বাসনা থেকে প্রথমে বই পড়া শুরু করি। দেখি- বইয়ের প্রতিটি পাতা ওর মুখ হয়ে ভেসে উঠছে আমার সামনে।

তারপর বই ছেড়ে ধরি সিগারেট। সিগারেটের প্রতিটি টানে, ধোঁয়ার মাঝেও দেখি ওর সেই হাসিহাসি মুখখানা।  মনে হতো- যদি স্মৃতি শক্তি লোপ না পায়- তাহলে ওকে কোনোদিন ভুলতে পারবো না আমি। যতই ভুলে যেতে চাই, ততই মনে পড়ে।

তারপর ধরলাম মদ।
তারপর হেরোইন।

এই ভয়াল মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য ঢুকে গেলাম অপরাধের অন্ধকার জগতে।

রিয়ার এসব কিছুই আর জানবার কথা নয়।

ইতি
রাজিব

চিঠিটা পড়ার পর দু’চোখ জলে ভিজে গেল আমার।

সেদিন বিকেলেই ওদের গ্রামের বাড়ি যাই আমি। গ্রামের প্রায় সবাই ওকে চেনে। ওদের বাড়ি চিনতে তাই সমস্যা হলো না। সবার মুখে একই কথা শুনলাম- “বড়ো ভালো ছিল ছেলেটা। কেন যে এভাবে নষ্ট হয়ে গেল?”

অদূরে দেখি সত্যিই একটা ঘর। যার উপরে ছনের চাল। ঘরের সামনে চৌকাঠে বসা মধ্যবয়স্কা এক নারী। ধারণা ভুল হলো না আমার- মহিলাটি রাজিবের মা।
উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “খালাম্মা, রাজিব কোথায়? বাসায় নেই?”

মহিলাটির বুকের পাঁজর মনে হয় ভেঙে গেল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল চোখের জল। কোনো শব্দ বেরুলো না মুখ দিয়ে। হাতের ইশারায় আমকে সামনে যেতে বলল।

দেখি একটা কবর।
বোঝাই যায় কবরটা একেবারে নতুন।
হ্যা। দু’দিন আগের।
এই তো দু’দিন আগে- ক্রস ফায়ারে মারা গেছে রাজিব।

একটা কবরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ি আমি।
পুরো পৃথিবীটা ঘোলাটে হয়ে আসে।
পশ্চিম আকাশের শেষাশেষি সূর্যটা ক্রমশ ম্লান হচ্ছে।
অস্ত যাবে এখনই।
সেই অস্তায়মান সূর্যের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে হাস্যোজ্জ্বল একটা মুখ।
মুখটা রাজিবের।
দাড়ি শোভিত।
ভীষণ পবিত্র।
কানের কাছে শুনতে পাই ভরাট কন্ঠে আবৃত্তি করছে ও-

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে
ভালোবাসার সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিই।
ভেঙে গুড়িয়ে দিই-
শত শত প্রেমিকের রক্তে গড়া
ভালোবাসার টুইন টাওয়ার।

তারপর হব ইতিহাস।
হব ইতিহাস।

সূর্যটা হারিয়ে যায়।
আমি হাঁটু গেড়ে বসে থাকি।
নিশ্চল। নিথর।

পরের দিন।
কলেজের মাঠটায় দাঁড়িয়ে থাকি আমি।
ঝড়ে ভেঙে যাওয়া একটা গাছের মতো।
নিঃশব্দে।

তাকিয়ে দেখি- সমস্ত কলেজ মাঠটা জুড়ে শত শত তরুণ তরুণী বসা।
জোড়ায় জোড়ায়।
কিছুই বদলায়নি।
কিছুই বদলায় না।
কেউ বেঁচে থাকলে।
কিংবা কেউ মরে গেলেও..................
                                           
(সমাপ্ত)
(ধৈর্য ধরে পুরো গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা)

▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
লেখার তারিখ: ৮ জুলাই, ২০০৬
গল্পগ্রন্থ : দহন
আসছে বইমেলা- ২০১৯
আরও গল্প পেতে এই পেজে #লাইক
দিয়ে কানেক্টেড থাকুন।
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
গল্পকার: ওয়াদুদ খান
প্রভাষক ইংরেজি বিভাগ, সদরপুর সরকারি কলেজ
লেখকের লেখা সকল উপন্যাস পেতে ডায়াল করুন:
📞📞☎☎ ১৬৭৩-৫৯ ৪৫ ৭৯ 
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬

Wednesday, 3 October 2018

কষ্টকথা সাফল্যগাথা | এক গ্রাম্য যুবকের সফল হওয়ার কাহিনি | উপন্যাস




উপন্যাস: কষ্টকথা সাফল্যগাথা
(পার্ট- ৬)

সেকেন্ড ইয়ারে উঠে একটা টিউশন পেয়ে গেলো স্বপন। শুনে খুব খুশি হয়েছিলো ফাহমি। এক মাস যেতে না যেতেই স্বপন বললো, “ফাহমি, টিউশনটা ছেড়ে দিলাম।”
“কেনো?”, জানতে চাইলো ফাহমি।
- আর বলিস না। মাইয়াটা খুব ফাজিল ছিলো। ক্লাস সেভেনে পড়ে। কিন্তু...
- কিন্তু কী?
- আমাকে অফার করে বসলো।
- অফার! কিভাবে করলো? শুনি।
- তুই তো জানিস, আমি খুব লাজুক টাইপের ছেলেতার মধ্যে গ্রাম থেকে এসেছি শহরে। টিউশনটা খুব দরকার। চুপচাপ পড়াই। কোনোদিকে তাকাই না। মাইয়াটা বলে...
- কী বলে?
- বলে যে- “আপনি কি মাইয়া মানুষ? এতো শরম কেনো আপনার? আচ্ছা, আপনার কি জিএফ নাই?” একথা শুনে আমি তো লজ্জায় শেষ। আমি বললাম, “এই, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো? জিএফ মানে কী?” মেয়েটি বললো, “স্যার, আপনি জিএফ মানে জানেন না?” আমি বললাম, “হ্যাঁ। জানি। জিএফ মানে হলো গুড ফ্রেন্ড। ‘জি’তে গুড আর ‘এফ’তে ফ্রেন্ড।”
হাসি পেলো ফাহমির। হাসি চেপে বললো, “তারপর?”  
- তারপর মাইয়াটা হাসি শুরু করলো খিলখিল করে। বলে যে- “স্যার, আপনি কি আঁতেল? নাকি বেতাল?” আমি বললাম, “মানে?” মেয়েটি বললো, “জিএফ মানে গার্ল ফ্রেন্ড। তবে স্যার আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে।”
- তুই কী বললি তখন?
- কী বলবো? বললাম, “এই মাইয়া, তুমি আমাকে কী বলতে চাচ্ছো? স্পষ্ট করে বলো।” তারপর মেয়েটি সরাসরি বলে দিলো, “জানেন স্যার, আমাদের ক্লাসের সব মেয়েরই বিএফ আছে। বিএফ মানে কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ড না। বিএফ মানে হলো বয় ফ্রেন্ড।  আমার শুধু বিএফ নাই। বয় ফ্রেন্ড মানে কিন্তু আবার ছেলে বন্ধু না।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বয় ফ্রেন্ড মানে কী?” মেয়েটি বললো, “বয় ফ্রেন্ড মানে হলো প্রেমিক। বুঝেছেন? এখন বলেন, আপনি কি আমার বিএফ হবেন?”
- তারপর তুই কী বললি? কী বললি মেয়েটাকে?
- বললাম, “আমার খুব হিসি পেয়েছে। টয়লেট কোনদিকে? তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।”
- হা হা হা। পালিয়ে চলে আসলি নাকি?
- হুম। মান সম্মান নিয়ে বেঁচে এসেছি। টিউশনটা ছেড়ে দিলাম। ঢাকা শহরে ছাত্রী পড়ানোর সাথে দেখি প্রেমটা ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে।
- ফ্রি প্রেমের অফারটা গ্রহণ করলি না কেনো?
- এতো প্রেম আমি কোথায় রাখবো? জায়গা নাই। আচ্ছা, ফাহমি তোর কী অবস্থা? আর তো আপডেট পেলাম না।
- কালকে একটা ডেটিং আছে।
- ডেটিং? রিয়েলি?
- ডেটিং বলতে ছেলেটাকে দেখতে যাবো। এফবিতে আমাকে প্রপোজ করেছে। আগে দর্শন, পরে ডিসিশন।
- গুড আইডিয়া। কোথায় আসবে ছেলেটা?
- আমাদের কলেজের গেটে। তারপর বেড়াতে যাবো- সোলস পার্কে। ফুচকা খাওয়ার প্লান আছে।
- ঠিক আছে। ডেটিং শুভ হোক। এখন রাখতে হবে। বিজি।
- ওকে। ভালো থাকিস।

এখন রাত দশটার কাছাকাছি।
ঢাকা শহরে রাত শুরু হয় অনেক দেরিতে। হাঁটছে স্বপন। রাতের খাওয়াটা এখনো হয় নি ওর। পকেটে মাত্র কুড়িটা টাকা আছে। দু’টি চিতই পিঠা ধনে পাতা বাটা দিয়ে কিনে খেলো স্বপন। রাতের খাবার হিসেবে মাঝে মাঝেই চিতই পিঠা খায় ও। শেফালি ফোন করে জানিয়েছে ওদের থাকার ঘরের পাঠখড়ির বেড়াটা পরিবর্তন করা দরকার। রিকশা চালিয়ে যা কামায় তা স্বপনের পড়ালেখার পেছনেই খরচ হয়ে যায়। তারপরেও, অনেক কষ্ট করে কিছু টাকা জমাচ্ছে ও

ফুল বেঁচে বস্তিতে ফিরছে দশ বছর বয়সী বিল্টু। স্বপনের সাথে বেশ ভালোই খাতির ছেলেটার। বিল্টু লেখাপড়া জানে না। তবে আগ্রহ আছে। স্বপন বিল্টুকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “বিল্টু, তোর মতো আর কয়জন আছে?”
- অনেকেই আছে স্বপন দা? ক্যান?
- লেখাপড়া শিখবি?
- দাদা, লেখাপড়া আমাগো লাইগা না। ঢাকা শহর বড়োলোক পোলাপাইনদের লাইগা
- লেখাপড়া শিখতে তোর ইচ্ছে করে?
- করলে কী লাভ?
- আচ্ছা, তোর মতো আর কতোজন আছে? এমন ফুল বেঁচে?
- অনেকেই আছে স্বপন দা? ক্যান জিগাইতেছেন?
কিছুক্ষণ ভাবলো স্বপন। তারপর বললো, “তোরা লেখাপড়া শিখবি? আমি তোদের শেখাবো। সপ্তাহে তিনদিন রাস্তায় জ্বলে থাকা লাইটের নীচে পাটি বিছিয়ে পড়াবো তোদেরপড়বি?”
উত্তরে বিল্টু বললো, “আপনে আমাগো কাছ থাইকা টাকা লইবেন না? মাগনা পড়াবেন?”
স্বপন বললো, “হুম। মাগনা পড়াবো। পারলে- তোদের বই কেনার টাকাও দিতাম।”
এক জাদুকরী প্রভাব আছে স্বপনের। মানুষকে কাছে টানতে পারে দ্রুত। বিশেষকরে বাচ্চাদের।  

তারপর থেকে বিল্টুদের সপ্তাহে তিনদিন পড়ায় স্বপন। স্বপনের স্কুলে এখন তেরোজন ছাত্র। সবাই “অ আ ই ঈ ক খ গ ঘ ১ ২ ৩ ৪” চিনে ফেলেছে।

এই ব্যস্ত নগরে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড়ে আঠারো বছরের এক তরুণ রাস্তার পাশে পাটি বিছিয়ে কাঠের টুলে বসে কিছু টোকাই ছেলেদের পড়াচ্ছে- সেটা যেনো দেখার কেউ নেই।   
এ শহরের যুব সমাজের সকলে যখন ব্যস্ত প্রেমে কিংবা কামে। ইয়াবা কিংবা গাঁজায়।
স্বপন তখন রিকশার প্যাডেলে পা দিয়ে গেয়ে যায়, “আমি হারবো না। হারবো না। হারবো না।”  

হার্ড কপির জন্য ডায়াল করুন:   ০১৭৮৫-৫৬২০৮০ 

Tuesday, 2 October 2018

অবাক অবক্ষয় | শিক্ষামূলক রম্য গল্প | চার পর্ব



 হাস্যরসাত্মক এই গল্পে রয়েছে সমকালীন বাস্তবতা

প্রতিটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য

পর্ব-১
▬▬▬▬

তখন সেপ্টেম্বর। কলেজে এলেন জামান স্যার। পুরো নাম- 'চৌধুরী আশফাক জামান'। ব্রত, পেশা কিংবা নেশা হিশেবে নয়; শিক্ষতাকে তিনি নিয়েছিলেন অনেকটা 'তামাশা' হিশেবে। এই জামান স্যারকে বাচ্চারা ডাকতো 'কামান স্যার' বলে। রোজ ভোরে ওয়ান টাইম রেজার দিয়ে 'দাড়ি কামান' বলে বাচ্চারা তার এ নাম রাখেনি।

নামের পেছনে ছিল ভিন্ন কারণ।

গত প্রিটেস্ট পরীক্ষা চলাকালে তিনি ক্লাসে ঢুকে মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে ফেসবুক লাইভে এলেন। বলতে লাগলেন, "হ্যাললো বউন্ধুরা, আমি জামান। এখন আছি পরীক্ষার হলে। আপনারা দেখুন- কীভাবে এ কলেজের বাচ্চারা নকলমুক্ত নয়; বরং নকলযুক্তভাবে আরামে, আয়েশে, কেউ কেউ ঘুমিয়ে কিংবা নেচে-গেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে..."
এক ছাত্র মৃদু শব্দে বলল,
"জামান স্যার,
দয়াকরে মোবাইলটা
নামান স্যার।"
এদিকে ফেসবুক লাইভে যখন মোবাইলটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো শ্রেণিকক্ষটা কাভার করছিলেন জামান স্যার, তখন হঠাৎ সজলের দিকে চোখ পড়ল ওনার। সজল বাম হাঁটুর ওপরে ফোন রেখে নেট গেটে কিছু সিনোনিম খোঁজার চেষ্টা করছিল। সেটা দেখে- সজলের নাক বরাবর সজোরে ন'শো টাকা দামের ওয়ালটন মোবাইলসেটটা ছুড়ে মারলেন জামান স্যার। কপাল থেকে রক্ত ঝরছিল সজলের। ওই ঘটনার পর থেকে  'জামান স্যার' বাচ্চাদের কাছে হয়ে গেলেন 'কামান স্যার'। বাচ্চারা তাঁকে নিয়ে ছন্দও বানিয়েছে কিছু-
"ও কামান স্যার!
বাড়াবাড়ি
কমান স্যার।

ও জামান স্যার
টাকা কড়ি
জমান স্যার।"

জামান স্যার বরিশালের ছেলে। তাই হয়তো একটু সাহসী। সেদিন বাতেনের টি-স্টলে 'কালো-সরু' একটি সিগারেট ধরিয়ে বাইরে তাকালেন ওনি, দেখতে পেলেন- বেঞ্চিতে বসে এই কলেজেরই এক ছাত্র, নাম তমাল, 'শাদা-সরু' একটি সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টানছে। বাচ্চাটির সিগারেট টানার স্টাইল অসাধারণ। লম্বা টান দিয়ে বুকের ভেতর ধোঁয়া নেয়। তারপর চায়ের কাপে চুমুক দেয় রাজার ভঙ্গিতে। ডান পা বাম পায়ের ওপরে রেখে সারা গা দুলুনি দেয়। বিড়ির ধোঁয়া চায়ের কড়া লিকারের সাথে পেটের ভেতরে গিয়ে মিশে যায়। ধোঁয়া আর বাইরে বেরোয় না।

মাথায় রক্ত চলে এলো জামান স্যারের। নিজের সিগারেটে সজোরে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাইরে বেরুলেন তিনি। ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলেন ছাত্রটির গালে। বাম হাতে থাকা সিগারেটের পশ্চাতদেশ ছিটকে পড়ল দূরে। চায়ের কাপ ভাঙার রিনিঝিনি শব্দ শোনা গেল অনেকটা দূর থেকেও। এক ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইতে এসে কেন চা খেয়ে চলে গেল- বোঝা গেল না।

জামান স্যারকে দেখে বাচ্চারা ভয় পায়। কিন্তু এতটুকু শ্রদ্ধা করে না তাকে। শ্রদ্ধা না করার কিছু কারণ যে নেই- তা কিন্তু নয়। ওনি নিজে যা করেন, তাই করতে দিতে চান না ওনার শিক্ষার্থীদের।

ডান হাতে বিশাল মোটা কালো ফিতের ঘড়ি, অন্য হাতে দুটো রুপোর মোটা বালা পরেন জামান স্যার। চুলও কাঁধ পর্যন্ত লম্বা। বেদম টাইট জিন্সের সাথে গোল-গলা কালো কুচকুচে টি-শার্ট পরে কলেজে আসেন তিনি। প্যান্ট বেশি টাইট হওয়ার কারণে দু পায়ের ঠিক মাঝ বরাবর একটু বিচ্ছিরি রকমের উঁচু হয়ে থাকে। সেটা নিয়ে কমনরুমে ছাত্রীরা হাসাহাসি করে। এই যেমন, ফেন্সি সেদিন রুম্পাকে বলছিল, "জামান স্যারের 'কামান' দেখেছিস? মাঝেমাঝে তো 'হিসু' করার পর প্যান্টের জিপারও লাগায় না। লুচ্চা একটা! ছাত্রীদের দিকে নিজেই হা-করে তাকিয়ে থাকে। আর ক্লাসে ছেলেদেরকে চিল্লায়ে বলে 'হারামজাদারা, মাইয়াগো দিকে তাকাইয়া থাকতে থাকতে তোদের চোখ ঘোলা করে ফেলেছিস'।"

সেদিন কলেজের গেটে জিন্স- টি-শার্ট পরে নিজেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, অথচ ছেলেদেরকে জিন্স পরার কারণে থাপড়িয়ে গেট থেকে বের করে দিচ্ছিলেন। একটা ছেলে তো বলেই ফেলল, "স্যার, আপনার পরনে কী? আপনিও তো জিন্স পরেন। আমরা পরলেই দোষ।" জামান স্যার যেন 'কামান' খুঁজতে লাগলেন। চেচিয়ে বললেন, "এই, এইটা কে রে?"
ছাত্রটি দৌড়ে পালাল। আর ছেলেটি মনে মনে বলল,
"আমাদের জামান স্যার
হাতে যেন 'কামান' তার।
পরেন টি-শার্ট, আর জিন্স
মানুষ তো নয়; স্যার একটা জিনিস।

জামান স্যার,
বাড়াবাড়ি
জারিজুরি
কড়াকড়ি
অকারণে ধরাধরি
এইবার থামান স্যার।"

জামান স্যারের চারিত্রিক গুণাবলি  দুধে ধোঁয়া, ছাকনিতে ছাকা তুলসি পাতার মতো নয়। এক সুন্দরী ছাত্রীর সাথে ফেসবুকে সতেরো দিন চ্যাটিংয়ের পর মেসেজ করেছেন তিনি, "আমাকে আর 'স্যার' নয় 'ভাইয়া' বলে ডাকবা। 'স্যার ট্যার' শুনতে ভাল্লাগেনা।" ছাত্রীটির নাম মল্লিকা মলি। বন্ধুরা খ্যাপায় 'মরলি ক্যা মলি' বলে। মল্লিকার প্রেমিক সংখ্যা অর্ধ ডজনের কম হবে না। কলেজের সবচেয়ে উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রটি যার নাম 'কোপা কামাল' সেও মল্লিকার প্রেমিক। অথচ, এই মেয়েটির সাথেই কিনা জামান স্যারও চ্যাট করেন। হায় রে কলিকাল!

পর্ব-২
▬▬▬▬
                              
তখন এইচএসসি বোর্ড পরীক্ষা চলছিল।

কেন্দ্রে প্রেবেশের আগে কলেজের বাইরে থাকা পুকুরপাড়ে কয়েকজন ছেলেমেয়ের জটলা দেখতে পেলেন জামান স্যার। তাদের ফিসফিস শব্দ দূর থেকেও শোনা যাচ্ছিল। একজন বলছে, "আধাঘণ্টা আগে হোয়াটসএপে প্রশ্ন পেলাম। বাঁশতৈল কলেজের সিদ্দিক স্যার প্রশ্নের প্যাকেট হাতে পেয়েই ছবি তুলে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে।"

পাশের 'মফিজ আলি ডিগ্রি' কলেজের শিক্ষার্থীরা এ কলেজে পরীক্ষা দিচ্ছে। 

সেদিন ইংরেজি পরীক্ষা চলছিল। দিন পরীক্ষা কক্ষে ঢুকেই জামান স্যার বললেন, "তোমরা একজনেরটা আরেকজন অবশ্যই দেখে লিখতে পারো- তাতে আপত্তি নেই। কেননা, আমি এসএসসি, এইচএসসি এমনকি বিসিএস রিটেন পর্যন্ত দেখাদেখি করে লিখে এসেছি। ক্যাডার হওয়ার পর গত ডিপার্টমেন্টাল ইকজামে পাঁচজন মিলে বই সামনে রেখে পরীক্ষা দিয়েছি। তবে বাচ্চারা, শব্দ করা যাবে না কিন্তু। আমি একটু নিরিবিলি ফেসবুক চালাবো।" জামান স্যার এটা বলবেনই না বা কেন- সেদিন পরীক্ষাপূর্ব মিটিংয়ে প্রিন্সিপাল স্যার বলে দিলেন, "এই যে নতুন স্যারেরা, বেশি কড়া গার্ড দিবেন না। পাশের মফিজ আলি কলেজের শিক্ষকরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের সর্বোচ্চ ছাড় দিবে। এমনকি ইংরেজি পরীক্ষার দিন ওই কলেজের দেবাশিষ গুপ্ত স্যার প্রশ্ন সল্যুশন করে ক্লাসে ক্লাসে বলেও দিবেন। আমরাও একইরকমভাবে ওদের হেল্প করব। গত বছর পাসের হার ছিল ৭৬ শতাংশ, এবার হবে ইনশাআল্লাহ ৯৪ শতাংশ।" সকল শিক্ষক করতালি দিচ্ছিলেন। শুধু জামান স্যার মুখে থাকা চুইংগামটি আর না চিবিয়ে নিচে ফেলে দিলেন।

জামান স্যার ফেসবুকে মন দিতে পারলেন না। প্রথমে হালকা গুঞ্জন, পরে মৃদু শব্দ, তারপর কোলাহল, চেচামেচি। প্রথম বেঞ্চের এক ছাত্র শেষ বেঞ্চের এক ছাত্রকে চেচিয়ে বলছে, "ওই শালা, রি-এরেঞ্জ কোন বোর্ড থেকে এলো রে? বুঝতেছি না!"

স্যার, মোবাইল থেকে চোখ তুললেন। দেখতে পেলেন- কালোমতো মোটাসোটা মাস্তান টাইপের একটা ছেলে নিজের বেঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে অন্য একটা বেঞ্চের মাঝে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে। জামান স্যারের মেজাজ গরম হয়ে গেল। ওই ছাত্রের কাছে গিয়ে বললেন, "এই ব্যাটা, উঠ। খাতা দিয়ে দে।" ছাত্রটি না উঠে বরং পকেট থেকে দু টাকা দামের একটি দেশলাই বের করল। সেটা শব্দ করে রাখল বেঞ্চের ওপর। একটি কাঠি বের করে সেটা দিয়ে স্যারের সামনেই প্রথমে কান, পরে হলদেটে দাঁত খোচাতে লাগল। স্যারের রাগ ও ঘেন্না বেড়ে গেল। টান দিয়ে খাতাটা নিয়ে নিলেন৷ কালোমতো মাস্তান টাইপের ছেলেটা সাপের মতো ফুসফুস করছে। আর হাতে থাকা দেশলাইটা বারবার নাড়াচ্ছে। কুড়ি মিনিট পর খাতাটি ফেরত দিলেন জামান স্যার।

একজনের খাতা হুবহু দেখে আরেকজনকে লেখার সুযোগ দেননি বলে শিক্ষার্থীরা জামান স্যারের ওপর ভীষণ খেপে গিয়েছে। একযোগে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে ঢুকে প্রতিবাদী ছন্দ ছেড়েছে ছাত্ররা,
"এই কলেজের জামান স্যার,
তাকে এবার থামান স্যার।"
ওদিকে বাইরে কিছু পোলাপান শ্লোগান দিচ্ছে-
"জামান স্যারের কল্লা
তুলে নেবো আল্লা..."
'তুলে নেবো আমরা' না বলে 'তুলে নেবো আল্লা' বলার রহস্যটা বোঝা গেল না।
ফিরে যাবার সময় প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে থাকা পুরাতন তিনটে চায়ের কাপ, আর দুটো কাঁচের গেলাশ সজোরে আছড়ে ফেলল একজন। কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল প্রিন্সিপাল স্যারের পাশে পুতুলের মতো বসে থাকা 'ধামাধরা' মকবুল স্যারের। আরেকজন ছাত্রকে দেখা গেল 'আম খাওয়ার চাকু' বাম পকেট থেকে বের করে ডান পকেটে ভরল। এই দৃশ্য দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ইকরাম স্যার কেন থরথর করে কাঁপছিলেন- বোঝা গেল না।

রাতের বেলা ঠোঁটে সিগারেট বসিয়ে, কানে হ্যাডফোন লাগিয়ে এফএম রেডিওর ঝাকানাকা গান শুনে চাপমুক্ত হবার চেষ্টা করছিলেন জামান স্যার। সহসাই জানালায় ঢিলের শব্দ। দ্রুম দ্রুম। গান শুনতে ব্যাঘাত ঘটছিল। হ্যাডফোন খুলে বাইরে বেরুলেন তিনি। একটা ঢিল এসে পড়ল জামান স্যারের চান্দিতে। হাত দিয়ে দেখলেন পাহাড়ের মতো ফুলে গেছে চান্দিটা, কিন্তু রক্ত বেরোয়নি। রাগে, ক্ষোভে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিতে লাগলেন তিনি। 

সবকিছু জানতে পেরে- পরেরদিন প্রিন্সিপাল স্যার জামান স্যারকে ডেকে টানা পঁয়তাল্লিশ দিনের ছুটি দিয়ে দিলেন। জামান স্যার বাম হাতে থাকা রুপোর বালা দুটো খুলে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন। খুশিতে নাকি রাগে এমনটা করলেন- তা বোঝা মুশকিল। বিড়বিড় করে শুধু বললেন তিনি,
"বাংলাদেশে স্যারের বেশে
আর না
যাব জার্মানি; কামাবো ক্যাশ-মানি;
আর ফিরবো না।
আমি জামান-
যাব জার্মানি, হব 'জার্মান'।"


পর্ব-৩
▬▬▬▬

অফুরন্ত ছুটিতে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটস এপ, কখনো বা ইংলিশ-হিন্দি মুভি দেখে অলস সময় কাটাচ্ছিলেন জামান স্যার। এরই মাঝে একদিন মল্লিকার ফোন,
"স্যার, আপনি খুব ভালো, খুব রোম্যান্টিক,
আপনার সবই সুন্দর, সব ঠিক।
আপনি হ্যান্ডসাম, আপনি অসাম,
আপনি কিউট, আপনি হিরো,
আপনি সুইট, নন ভীরু।
আপনি চলেন নায়কের মতো,
আপনার কণ্ঠটা গায়কের মতো।
আপনি এই,
আপনি সেই....."
জামান স্যার প্রশংসার বৃষ্টিতে ভিজে আবেগে আপ্লুত হলেন। কোথায় যেন তিনি শুনেছিলেন, "সব চায়ের কাপে চুমুক দিতে নেই"- তবে এখন সেটা মনে রাখা কিংবা মানার সময় নয়।

ছুটির দিনগুলি মল্লিকার সাথে চ্যাটিংয়ের রোম্যান্টিকতায় বেশ ভালোই কাটছিল।


পর্ব-৪
▬▬▬▬

ছুটি শেষ।
কলেজে ফিরলেন জামান স্যার। কলেজের অবস্থা আগের চেয়েও ভয়াবহ। ক্লাসেক্লাসে প্রেম, বেঞ্চেবেঞ্চে প্রেম। পুকুরের ঘাটে প্রেম৷ ক্লাসের বাইরে রেস্টুরেন্ট কিংবা ফাস্টফুডের দোকানেও প্রেম জমে ওঠেছে।

উত্তর দিকের চারতলা ভবনের দোতলায় জামান স্যারের ডিপার্টমেন্ট। তখন বেলা আড়াইটার মতো বাজে। দূর থেকে দেখলেন- মল্লিকার মতো একটি মেয়ে পশ্চিম দিকের তিনতলা বিল্ডিংয়ের দোতলার কক্ষ নম্বর ২০৮- এ ঢুকছে। মল্লিকার সাথে সাক্ষাত করার ইচ্ছে হলো ওনার। টয়লেটে ঢুকে পরপর দুটো বিড়ি খেয়ে মাথাটা ফ্রেশ করে নিলেন ওনি।

২০৮ নম্বর কক্ষের সামনে দুজন ছেলে দাঁড়ানো। দরোজার এপাশ-ওপাশ পায়চারি করছিল তারা৷ স্যারকে দেখে ভীত হলো। স্যার জোরে ধমক লাগালেন, " ঐ তোরা এখানে কী করিস। ভাগ।" ছাত্র দুটি পকেট থেকে মোবাইল বের করে বাটন চাপতে চাপতে চলে গেল।


রুমটির মূল দরোজা বাদে অন্যান্য দরোজা-জানালা বন্ধ। কোনো লাইটিং নেই। বেশ অন্ধকার। দরোজার পাশে থাকা ইলেক্ট্রিসিটির সুইচ অন করলেন জামান স্যার। আলোকিত হয়ে উঠল রুম। স্যার যা দেখলেন- সেটা দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। বজ্রাঘাতের মতো মনে হলো ওনার। সন্ত্রাসী ছেলেটা 'কোপা কামাল' যার নাম তার সাথে আলিঙ্গনরত অবস্থায় সেই মল্লিকা নামের মেয়েটি। তীব্র ঘেন্নাবোধে কোনো শব্দ বেরুলো না স্যারের মুখ থেকে। তারমানে, বাইরে থাকা ওই ছাত্র দুজন এই অপকর্মটা পাহাড়া দিচ্ছিল। হায়! হায়!

▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
সেদিন তখন রাত বারোটার ওপরে৷ কলেজের খোলা মাঠে বসে কোপা কামাল, সজল আর কালোমতো মাস্তান টাইপ ছেলেটা সিগারেটের ভেতর গাজা ভরে আয়েশে সুখটান দিচ্ছিল। পাশেই রয়েছে সদ্য কেনা এক বোতল বাংলা মদ। মাতালের মতো ভঙ্গিতে সজল বলল, "শালারা, স্যারের বুক বরাবর প্রথম চাক্কুটা আমি মারুম। মোবাইল দিয়ে আমারে ঢিল মারে৷ শালার পো..."
মাস্তান ছেলেটা মনে হয় এক প্যাগ বেশি খেয়েছে। কণ্ঠে জড়তা।  বলল সে, "শালার পাছায় আমি দেবো বাঁশ। পরীক্ষার সময় আমার খাতা আটকায়ে দিছিল। কত্ত বড়ো সাহস শালা পুতের..."
কোপা কামাল মনে হয় ঘুম থেকে জাগলো। ঘোরের মধ্যে বলতে লাগল সে, "আমি দেবো কোপ। অনেকদিন হয়ে গেল কাউরে কোপাই না। সর্বশেষ বীরপুশিয়ার তমালরে কোপাইছিলাম... চৌদ্দটা কোপ দিছিলাম ঠ্যাঙে... কোপামু রে কোপামু..."

▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
সেদিনের ওই ঘটনার পর এক রহস্যময় কারণে জামান স্যারকে আর কলেজে দেখা যায়নি
                                                    
                                                   (সমাপ্ত)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
গল্পকার: ওয়াদুদ খান
প্রভাষক ইংরেজি বিভাগ, সদরপুর সরকারি কলেজ
লেখকের লেখা সকল উপন্যাস পেতে ডায়াল করুন:
 ০১৬৭৩-৫৯ ৪৫ ৭৯ 
ফ্রি পড়তে চাইলে ভিজিট করুন:
 www.khanwadud.blogspot.com/ 
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬

Wednesday, 5 September 2018

মেয়েটি অনেক বড়ো হয়ে গেছে | হৃদয় ছোঁয়া ছোটোগল্প


মেয়েটি অনেক বড়ো হয়ে গেছে
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬

🔵 মোট চারপর্বের অসাধারণ হৃদয়ছোঁয়া ছোটোগল্প।
🔵 সংগ্রামী প্রতিটি নারীর জন্য এই গল্পটি অবশ্যই পাঠ্য।

(পর্ব-১)
▬▬▬
বন্ধুদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করে বাসায় ফিরছিল রুমা। বাসায় ফেরার আগেই বোমা পড়ল রুমার মাথায়। বলে কী সানজিদা- "রুমা, শোন। তোকে আজকে একটা ছেলে দেখতে এসেছে। ইয়া লম্বা। মোটাও মোটামুটি।"

রুমা ক্লাশ এইটে পড়ে। বয়স ১৩ বছর দুই মাস। বড়ো হওয়া কাকে বলে- এখনও ওর কাছে স্পষ্ট নয়। লজ্জায় কাউকে বলতেও পারে না- "আচ্ছা, মেয়েরা বড়ো হয় কীভাবে?"

তবে কোথাও যেন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেছে- যা তার সম্পূর্ণ অপরিচিত। এইতো মাস দুয়েক আগে ও একা একাই চুইংগাম কিনতে পাশের এক দোকানে গিয়েছিল। বাসায় ফিরতেই মায়ের চিৎকার- "হারামজাদি, কৈ গেছিলি? বাইরে যাইয়া রূপ না দেহাইলে পেটের ভাত হজম হয় না তোর। এখন বড়ো হইছস। বাইরে যাইয়া এতো হাওয়া খাওন যাইবো না।"

চোখে জল চলে এসেছিল রুমার।
অথচ, কতো অসংখ্যবার সে একা একাই ঐ দোকানটাতে গিয়েছে। পাড়ার সব ছেলেদের সাথে ক্রিকেটও খেলতো ও। আজ সব বারণ। ক্রমাগত পৃথিবীটা উড়নার আবরণে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল ওর।

ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত এক সাথে ফারুক, রুবেল, আবীরদের সাথে প্রাইভেট পড়েছে রুমা। কখনো মনের ভুলেও কিচ্ছু মনে হয়নি। তিনদিন আগে আবীর একটা নোটের জন্যে রুমার কাছে এসেছিল। আবীর খুব ভদ্র ছেলে। নোট দেবার সময় স্টার জলসার একটা সিরিয়াল নিয়ে ওরা দুজন হেসেছিল। কিন্তু কী আশ্চর্যের ব্যাপার! আবীর চলে যাবার পর- কথা নেই, বার্তা নেই মা এসে কষে এক থাপ্পড় মারলো রুমার গালে, "শয়তান, বদের হাড্ডি। পোলাগো লগে তোর কিসের এত হাসাহাসি? পাড়ার লোকেরা নানান সমালোচনা করে। সে খেয়াল আছে।"

জানালার পর্দা খুলে রুমা বাইরে তাকায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ও। ওই যে দূরে একটা মাঠে কিছু ছেলে-মেয়ে একত্রে গোল্লাছুট খেলছে। দৌড়ে ওদের কাছে যেতে ইচ্ছে করে রুমার। মনে মনে বলে, "মা দেখো- এই তো আমি ছোটই আছি। আমি একটুও বড়ো হইনি.................."

মেয়ে বন্ধুদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করে সেদিন বাসায় ফিরছিল রুমা। বাসায় ফেরার আগেই বোমা পড়ল রুমার মাথায়। বলে কি সানজিদা- "রুমা, শোন। তোকে আজকে একটা ছেলে দেখতে এসেছে। ইয়া লম্বা। মোটাও মোটামুটি।"
রুমার মাথা এবং কথা দুটোই অফ হয়ে গেল। একটা ছেলে ওকে দেখতে এসেছে। "আচ্ছা, 'দেখতে আসা' কাকে বলে? আমাকে দেখার আবার কী আছে? রোজ স্কুলে যাবার পথে কত ছেলেরাই তো আমাকে দেখছে। ওহ! কী হচ্ছে এসব?"
রুমা বাসায় আজ যাবেই না।

পাশেই রুবিদের বাসা। রুবি ওর সাথেই পড়ে। রুমা রুবিদের বাসায় গেল। বসে বসে লুডু খেলছিল ওরা। হঠাৎ দেখে পাশেই ওর চাচাতো বোন, ভাবী ও প্রতিবেশি অন্যান্য মেয়েরা, "ঐ তুই পালাইয়া রইছস ক্যান? পোলাডা কিন্তু একের। সৌদি থাকে। সাত ভরি গয়না আনছে বৌয়ের লাইগ্যা। এমন আগুনের গোলার মতো পোলা খুব কম মাইয়ার কপালেই জুটে।" কেউ একজন বলল, "অনেক লেইট হইয়া গেছে। তাড়াতাড়ি রেডি করো রুমারে।"
রুমা পালাবার পথ খোঁজে। না পালাবার জায়গা নেই। একটা ছোট্ট নারীকে আঁকড়ে ধরেছে অন্য দশটা বড়ো নারী। রুমার মনে হচ্ছিল- এই ছোট্ট জীবনের বিশাল স্বপ্নগুলো শাড়ীর কফিনে ঢুকে যাচ্ছে।
কিন্তু কেন?
মেয়েটি নাকি অনেক বড়ো হয়ে গেছে!
স্বপ্নশূন্য মন আর শক্তিশূন্য শরীর নিয়ে রুমা নিজেকে জিজ্ঞেস করে যায়,
"আচ্ছা, বড়ো হওয়া কাকে বলে?"

(পর্ব-২)
▬▬▬
সুদৃশ্য চেয়ারে লাল শাড়ী পরে বসে থাকা ছোট্ট মেয়ে রুমার নিজেকে কোরবানীর গরু বলে মনে হলো। দাম দর ঠিক করে যাকে কিছুদিন পরেই বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে আয়েশ করে জবাই করা হবে।

পান খেতে খেতে এক মহিলা এগিয়ে এলো রুমার দিকে। পানের পিচকি রুমার সামনে ফেলে জিজ্ঞেস করল, "এই মাইয়া কাম টাম কিছু পারো? আমাগো কাম টাম তেমুন নাই। মাত্র পাচজুনের সংসার। জামাইতো বিদেশেই থাকবানে। খালি এট্টু ভাত আর ডাউল রানবার পারলেই চলবো।" তারপর একটা হাসি দিলো- হাসির সময় পানের লালজল গড়িয়ে পড়ল ঠোঁট বেয়ে। রুমা মনে মনে বলল, "এই মহিলাটা কে? পেত্নি বলতে কিছু একটা আছে- আচ্ছা, পেত্নি কি এই মহিলাটার চাইতেও কুৎসিত?"

পাশ থেকে ভাবী এসে বলল, "এই রুমা, সালাম কর পায়ে ধরে। এইডা তোর হবু শাশুড়ি। দেখতাছস না কত ভালা মানুষ উনি।"

রুমার ঘেন্না ধরে গেল। পারলে এখনই চিৎকার করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

আরেকজন মধ্যবয়স্ক মহিলা এসে হাজির। "মাইয়া তোমার চুলগুলান একটু বাইর করো তো- দেহি, কতখানি লম্বা।"- বলেই মহিলাটি রুমার অনুমতি না নিয়েই মাথার ঘোমটা খুলে চুল পরীক্ষা করা শুরু করল। রুমার গা শিউরে উঠল। মহিলাটির গালে একটা কড়া থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে ওর।
তারপর, আরেকজন এসে রুমার হাত, পা- এমনকি দাঁত পর্যন্ত পরীক্ষা করল। হ্যা, সব ঠিকঠাক আছে। কোরবানির গরুর কোনো ত্রুটি নেই। জবাই দেয়া যায়। তারপরেও আরেকজনের পালা- "মাইয়া তোমার নাম কী? বাবা কী কাম করে? ভাইবুন কয়জুন?"- এইসব আউল ফাউল প্রশ্ন করে যাচাই করল রুমা বোবা কিনা।

রুমার মনে অনেক প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে, "আচ্ছা, ছেলেদের কী এভাবে গরুর মতো বিয়ের সময় যাচাই বাছাই করা হয়?"

এবার দর কষাকষির পালা।
কনেকে বর পক্ষের খুব পছন্দ হয়েছে। মুরুব্বি শ্রেণির এক লোক বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, "আমাগো একের পোলাডার লাইগা এমন কচি মাইয়াই পছন্দ। যারা কলেজ ভার্সিটিতে পড়ে তাগো আমাগো পছন্দ না। তারা নাহি হেসবুক, টেসবুক চালায়। পিরিতি টিরিতি করে। বুঝেন তো- কলিকাল। ফ্রেশ মাইয়া পাওয়া খুব জ্বালা।" কথাগুলো শুনতে এতটাই অশ্লীল লাগল রুমার কাছে যে ওর বমি চলে এলো। এই লোকটা নাকি রুমার শ্বশুর হবে? ভাবা যায়।

আরেকজন মুরুব্বি কিছিমের লোক বলল, "আমাগো পোলার কুনু ডিমান্ড নাই। মেলা টেহা পয়সা, গয়না গাট্টি নিয়া আইছে। কিন্তু ছোট্ট একখান আবদার আছে আমাগো।" কী আবদার জানতে চাইলে লোকটি বলল, "একখান মোটর সাইকেল দেওন লাগবো। পোলার খুব শখ।"

মনে হয় গরুর হাট বসেছে।
অনেকক্ষন দরদামের পরে ঠিক হলো- হ্যা, ছেলে একটা মোটর সাইকেল পাবে। তবে মেয়েকে সাত ভরি স্বর্ণ নগদ দিতে হবে।
রুমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না। যে মানুষটাকে সে চিনে না, জানে না, জীবনে দেখেওনি- তার সাথে ওর একসাথে থাকতে হবে কেন?

দিনক্ষন ঠিক হয়ে গেল।
আগামী সতের তারিখ, শুক্রবার ওর বিয়ে।
পাড়া-পড়শির মন্তব্য--- "দেখছো, মাইয়ার চেহারা ভালা অইলে কী অয়? বিদেশি টেহাওয়ালা পোলার লগে অল্প বয়সেই বিয়া ঠিক অইয়া গেল। আসলে, টান থাকতেই মাইয়াগো বিয়া দেওন ভালা। রাজরানির কপাল আমাগো রুমার!"

এখন মাঝ রাত।
চারদিকে গভীর অন্ধকার।
রুমা বসে বসে ভাবছে, "আমি পালিয়ে যাব। আসছে শুক্রবারের আগেই। যেভাবেই হোক।"
কিন্তু এই পিচ্চি মেয়ে রুমা কোথায় যাবে?
কার কাছে যাবে?
এই অসীম পৃথিবীতে রুমাদের কি থাকার এতটুকু জায়গা আছে????

(পর্ব-৩)
 ▬▬▬

- স্যার, খবর শুনেছেন?
- কোন খবর, আবীর?
- রুমার তো আজ বিয়ে। সবই ঠিকঠাক। বরপক্ষ চলে এসেছে।
- তাই তো বলি, রুমাকে কিছুদিন ধরে স্কুলে আসতে দেখি না কেন? আচ্ছা, কী করা যায় বলতো, আবীর? ওকে তো বাচানো দরকার।
- স্যার, আমরা সবাই মিলে চেয়ারম্যানের কাছে যেতে পারি।
- হ্যা। গুড আইডিয়া।

ইনি আমাদের হাকিম স্যার। 'বেক্কল মাস্টর' হিসেবেই উনি বিশেষ পরিচিত। আড়ালে আবডালে কেউ কেউ 'পাগলা স্যার' হিসেবেও সম্বোধন করে। কারণ, কিছুদিন আগে পাঞ্জাবির সাথে উনি যে পায়জামাটা পরে স্কুলে গিয়েছিলেন- সেটা উনার পাঞ্জাবির পায়জামা ছিল না। সেটা ছিল উনার বউয়ের পরার পায়জামা। বিশেষ করে ছাত্রীরা তো উনাকে দেখে হেসে কুটিকুটি। পারলে ক্লাসের বেঞ্চেই গড়াগড়ি খায়। স্যার মেয়েদের হাসি দেখে বলে, "বুঝেছি,পায়জামা তোমাদের ভালো লাগে না। ওকে, এরপর থেকে পায়জামাই পরবো না। শুধু পাঞ্জাবি পরেই চলেই আসব।" হাসির শব্দ আরও বেড়ে যায়।

হাকিম স্যার প্রাইভেট পড়ান না। দুর্বল স্টুডেন্টদের উনি ফ্রি পড়িয়ে থাকেন। জোর করে টাকা দিতে চাইলেও- উনি নেন না। এইজন্যে রোজ বউয়ের গালি খান, তবে স্টুডেন্টদের হাতের তালি পান। গালি খেয়ে, কিন্তু হাতের তালি পেয়ে উনার দিন কাটে। টিউশন ফি নেন না বলে- তথাকথিত সমাজের সচেতন নাগরিকরা উনাকে 'বলদ মাস্টর' বলে অভিহিত করেন। একটু অন্যমনস্ক টাইপের লোক হলেও,  উনি কথাবার্তা খুব গুছিয়ে বলতে পারেন। অঙ্ক বুঝাতে পারেন খুব ভালো। শুধু তাই নয়- উপস্থিত ছন্দ বানাতে উনি উস্তাদ। এই তো কিছুদিন আগে- ক্লাসের মধ্যে উনি ছন্দ ছাড়লেন এরকম: 

আমি ইট, তুমি খোয়া
আমি মুড়ি, তুমি মোয়া
তুমি শাবনুর, আমি রিয়াজ
তুমি কাচালঙ্কা, আমি পিয়াজ
আমি কান্না, তুমি হাসি
আমি যক্ষা, তুমি কাশি
আমি খাল, তুমি ব্রিজ
আমি মাছ, তুমি ফ্রিজ
আমি গান, তুমি সুর
আমি কাছে, তুমি দূর
তুমি ছাগল, আমি গরু
আমি শেষ, তুমি শুরু
আমি আপন, তুমি পর
আমি বৃষ্টি, তুমি ঝড়
তুমি চড়ুই, আমি দোয়েল
আমি দেব, তুমি কোয়েল
আমি চোর, তুমি পুলিশ
তুমি চালাক, আমি ফুলিশ
আমি কৈ, তুমি ইলিশ
তুমি মাল, আমি জিনিস
তুমি আছো, আমি ফিনিশ
তোমার চৌদ্দ, আমার তিরিশ
তুমি দামী, আমি ফাও
আমি হারাই, তুমি পাও...............

শেষ করার আগেই করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে ক্লাসরুম। যথেষ্ট মেধাবী হয়েও- শিক্ষকতাকে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেয়ায়- অনেকেই বলেন, "হাকিম মাস্টারের জ্ঞানের অভাব আছে। বিএসএসি পাশ করেও- কেউ মাস্টারি করে।"
হাকিম স্যার খুব দ্রুত ছুটছেন। সময় বেশি নেই। এখনই- চেয়ারম্যানের কাছে যেতে হবে। তার আগে তিনি হেড মাস্টারের রুমে গেলেন।

- স্যার, আপনাকে কিছু বলবার ছিল।
- হ্যা, হাকিম সাহেব বলেন- কী বলবেন? বলুন।
- স্যার, আপনি কি জানেন- এইবার ক্লাস এইটের সবচাইতে মেধাবী কে? ছাত্র প্লাস ছাত্রীদের মধ্যে?
- দেখলে হয়তো চিনব। নামটা জানি না তো। কেন হাকিম সাহেব? কী হয়েছে।
- তার আগে বলেন- স্যার, আপনি কী চাইবেন আপনার স্কুল থেকে আপনার সবচাইতে মেধাবী স্টুডেন্টকে হারিয়ে ফেলবেন?
- না। তা তো কক্ষনো চাইবো না।
- তাহলে স্যার শুনেন- ক্লাস এইটের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রী মিস রুমার আজ বিয়ে। মেয়েটির বয়স এখনো চৌদ্দও হয়নি।
- ওহ! এই ব্যাপার। কিন্তু হাকিম সাহেব- আমাদের কী করনীয়? যেখানে মেয়েটির বাবা-মা রাজি- সেখানে কী আমাদের কোনো ভূমিকা আছে?
- হ্যা স্যার, অবশ্যই আছে। আমরা শিক্ষক। আমরাও প্রতিটা ছেলেমেয়ের বাবা-মা। আমরা জাতির বিবেকও। আমরা যদি স্যার না জাগি- তাহলে সকাল তো কোনোদিন আসবে না।
- কিন্তু..................
- স্যার কোনো কিন্তু নেই। আপনি শুধু আমাকে সহায়তা করেন। আমার সাথে একটু চলেন।
হেড মাস্টার আর না করতে পারলেন না। তিনিও চললেন।

(পর্ব-৪)
▬▬▬
বরের নাম রুহিন। মোটামুটি মোটা বলে সবাই ওকে 'মোটকু রুহিন' বলে ডাকে। জিন্সের প্যান্টের ওপরে হাফ হাতা কালো-সাদা চেকের শার্ট পরে এসেছে বিয়ে করতে। তবে মাথায় মুকুট পরতে ভুল করেনি মোটকু রুহিন। বরের এই ড্রেস দেখে চোখ গোল হয়ে গেল রুমার চাচীর। জিজ্ঞেস না করে চাচী থাকতে পারলেন না, "বরের কি কান্ডজ্ঞান নাই? বিয়ার দিন পাঞ্জাবি পায়জামা পরা ছাড়া কোনো বর আসে নাকি?" উত্তরে রুহিন বলল, "আসলে হইছে কি চাচীম্মা, পরথম বিয়া তো! তাই একটু ভুল অইবার লাগছে। পরেরবারে ইংশাল্লা ভুল করব না নে।" অন্দর মহলে হাসির রোল বয়ে গেল।

দূর থেকে বিয়ে বাড়ির গান শোনা যাচ্ছে। বাঙালির রুচিবোধ কতটা বিকৃত হয়েছে তা ওই গান না শুনলে বুঝতে পারতেন না হাকিম মাস্টার। একটা নারী কণ্ঠের গান-
"তুমি দিয়ো না-কো বাসর ঘরের বাত্তি নিভাইয়া.........
আমি অন্ধকারে- বদ্ধঘরে যাবো মরিয়া..............."

হাকিম মাস্টার, স্কুলের হেড স্যার, হবি চেয়ারম্যান আর দুজন পুলিশের কনস্টেবল বিয়ে বাড়িতে ঢুকছে। দূর থেকে ওদের দেখেই পেট খারাপ হয়ে গেল বরের। রুবিকে দেখেই বলল, "ও খালাম্মা, আপনাগো হাগুখানা কোন দিকে?"

টয়লেটের দরজায় সিটকিনি লাগিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নিল বর রুহিন। গু-এর গন্ধে ভুলে গেল বিয়ের সৌরভ। বরপক্ষের অন্যান্য আত্মীয়রা আশে পাশের পাটক্ষেতে আশ্রয় খুঁজল।
বাল্য-বিবাহের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে রুমার বাবা-মাকে বুঝানো হলো এভাবে:

অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিলে- মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অল্প বয়সে বাচ্চা হবার সম্ভাবনা তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। এমনকি মারা যেতে পারে নবজাতক শিশু ও তার মা। শারীরিকভাবে দুর্বল মা- জন্ম দিয়ে থাকে শারীরিকভাবে দুর্বল শিশু। সংসার জ্ঞান না থাকায়- অল্পবয়সী মেয়েরা শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে খাপ খেয়ে চলতে পারে না। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কেও ভাঙনের সম্ভাবনা প্রবল হয়। কুড়িতে বুড়ি হয় এমন বাল্যবিবাহিত মেয়েরাই। আর, বর্তমানে একটি মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে বাবা-মায়ের তেমন টাকা-পয়সাও লাগে না। লাগে একটু সদিচ্ছা আর সচেতনতা। সরকার মেয়েদের শিক্ষাকে অবৈতনিক করেছে এবং মাসে মাসে উপবৃত্তির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। একটা ছেলে যেমন সংসারের বাতি, মেয়েও তাই। একটা মেয়েও ধরতে পারে সংসারের হাল। কন্যা সন্তান কোনো বোঝা নয়। বরং পরিবার ও দেশের সম্পদ।

রুমার বাবা-মা তাদের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো।
'পাগলা স্যার' হিসেবে পরিচিত হাকিম স্যারের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এলো তথাকথিত এলিট শ্রেণির মানুষের।
সমাজ হাকিম মাস্টারদের কিছু না দিলেও, হাকিম মাস্টাররা সমাজকে নিঃস্বার্থে সেবা দিয়ে যাচ্ছে অবিরাম।

"স্যালুট হাকিম স্যার! জাস্ট হ্যাটস অফ!!!" মনে মনে বলল রুমা।
কিছু ভালো মানুষের উপস্থিতিতে পৃথিবীটা কতো সুন্দর হতে পারে!
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬

বছর দশেক পর। 
ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় একা একা হাঁটছিলেন হাকিম মাস্টার।
হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন এক চব্বিশ বছরের মেয়ে তার পা জড়িয়ে ধরেছে। মেয়েটির পরনে পুলিশের ড্রেস। ব্যাজ দেখে বোঝা যায়- মেয়েটি পুলিশের এসিপি (বিসিএস ক্যাডার)।

মেয়েটি আর কেউ নয়।
সেদিনের সেই পিচ্চি মেয়ে রুমা। এক অপার্থিব ভালোলাগায় জল চলে এলো হাকিম স্যারের চোখে। মেয়েটি তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক অপূর্ব যুবককে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলো- "উনি মিস্টার সৌম্য। ডক্টর (বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার) সৌম্য চৌধুরী। আমার হাজব্যান্ড।"

পরিতৃপ্তিবোধে নির্বাক হয়ে যাওয়া হাকিম মাস্টার মনে মনে বললেন, "মেয়েরা, যদি তোমরা জিতো, তাহলে আমরাও জিতি। জাস্ট হ্যাটস অফ....................."
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬

গল্পকার: ওয়াদুদ খান
প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, সদরপুর সরকারি কলেজ
লেখকের প্রকাশিত সকল উপন্যাস পেতে:
📞📞 ☎☎ ০১৬৭৩-৫৯৪৫৭৯ ☎☎📞📞
ফ্রি পড়তে ভিজিট করুন : wadudkhan.blogspot.com

▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬

Friday, 22 December 2017

মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলি......


সালটি ১৯৭১। মাসটি ছিল জুলাই।

ভরা বর্ষা। চারদিকে পানি থৈ থৈ করছে। প্রচন্ড ভয় নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে এসেছিল জয়নাল চাষার ছেলে। অশিক্ষিত বয়স পনের। ওরা গরিব মানুষ। এক বেলা খায় তো আরেক বেলা না খেয়ে থাকে।

বিড়ি ধরিয়ে ছিপ ফেলে মাছের জন্য অপেক্ষা করতে বেশ লাগে ওরসুতোতে টান লাগলে মনটা নেচে ওঠে। হ্যা, একটু আগেই বড়ো একটা বোয়াল বড়শিতে আটকা পড়েছে। কিন্তু, ইদানীং কোথাও কোনো সুখ পায় না সে।
মাঝে মাঝেই নদীতে মরা মাছের বদলে ভেসে আসে মরা লাশ। পঁচা লাশ। দুর্গন্ধযুক্ত লাশ। দেশে নাকি যুদ্ধ চলছে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। জয়নালদের গ্রামে এখনো মিলিটারি ঢুকেনি। তবুও গ্রামের বেশিরভাগ লোক বাড়ি ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে।

শিকদার পাড়ার মুকাদ্দেস নাকি মুক্তি বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। সেই অপরাধে জব্বর মুনসি মিলিটারি ডেকে এনে সুন্না বাজারে সবার সম্মুখে তাঁকে জবাই করেছে। জব্বর মুনসি নাকি দেশপ্রেমিক। আর মুকাদ্দেস হচ্ছে দেশদ্রোহী।

মেট্রিক পাস খলিলের কাছে গিয়ে মাঝে মাঝে রেডিওতে খবর শুনে জয়নাল। দেশে নাকি মুক্তিযুদ্ধ চলছে। কিছু তরুণ জীবনবাজি রেখে ঝাপিয়ে পড়েছে দেশকে মুক্ত করার জন্য। জয়নাল সেসবের অর্ধেক বোঝে। অর্ধেক বোঝে না।

বোয়াল মাছটা কাঁধে নিয়ে বড়ো একটা ছনের ঘরে ফিরল জয়নাল। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামছে। বাড়ির সবাই কাপড়ের পুটলি গোছাচ্ছে। পরেরদিন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়া চলে যাবে সবাই। পাশের গ্রামে গতকাল রাতে আগুন দেয়া হয়েছে। আজকে এই গ্রাম আক্রান্ত হতে পারে ভয় ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।

জয়নালের এই ছনের ঘর ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। ঐ নদী, বয়ে চলা জলধারা, ডিঙি নৌকা, বিকেলে ছিপ ফেলে মাছ শিকার- এ সবই তাঁকে আকর্ষণ করে।

জয়নালের দাদি বৃদ্ধ। বয়স আশির কাছাকাছি। হাঁটতে পারেন না। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন। ইমানের সাথে মৃত্যু নছিবের জন্য রোজ নামাযে প্রার্থনা করেন। তিনি কীভাবে যাবেন ওদের সাথে? রাত বাড়ছে। বাড়ছে আতঙ্কও। অবশেষে পরিবারের সবাই সিদ্ধান্ত নেয়, আজকে রাতটা ওরা পাশের কোনো গ্রামে আশ্রয় নেবে। আগামীকাল সকালে বাবা এসে দাদিকে নিয়ে যাবে। আজ রাতটা দাদি এখানেই থাকুক। বৃদ্ধ মানুষ। তাঁকে কেউ আক্রমণ করার কথা না। মিলিটারিরা নাকি মুসলমান। কলেমা বলতে পারলে নাকি সব মাফ। দাদির চার কলেমা ঠোটস্থ।

ছবি: ইন্টারনেট

ওরা কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা পুরাতন পরিত্যাক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেয়। দূর থেকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পায় ওরা ভয়ে শরীর হিম হয়ে আসে সবার। কোনোরকমে রাতটা কাটায় ওরা। দিনের আলোতে গ্রামটাকে কেমনযেন মরুভূমি মনে হয়। ভূতুড়ে লাগে। কোথাও কেউ নেই। সুনসান নীরবতা।

জয়নালদের সেই বড়ো ছনের ঘরটিও আর নেই এখন। পুড়ে ছাই হয়ে আছে। আর দাদি?

কিছু কয়লা হাতের তালুতে নিয়ে কেঁদে দিলো বাবা।

মা, মা গো, আমি পারলাম না... ক্ষমা করে দিও...

কবি ও কথাশিল্পী
সদরপুর, ফরিদপুর

ওয়াদুদ খানের সাড়া জাগানো তিনটে উপন্যাস কিনতে ডায়াল করুন:
01785-562080 এই নাম্বারে।