Wednesday, 13 September 2017

দহন (যে দীর্ঘশ্বাস থামেনি আজও!)

আমি ভুলেও ভাবিনি, স্বপ্নেও কল্পনা করিনি কোনোদিন- ওখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর একজোড়া চোখ, কিছু পাগল করা শব্দ- আর সেই চোখে, সেই শব্দে আমার জীবনের সর্বনাশ।
 
এখান থেকে শুরু
                                          

(পর্ব-১)

আজ ১০ ডিসেম্বর।
এই দিনটা এলেই বুকটা মোচড় দেয়। চোখজোড়া ভীষণ ঝাপসা হয়ে আসে। বড্ড দিশেহারা হয়ে যাই। বুকের একটা নাম না জানা জায়গায় চিনচিনে ব্যথা হয়। নিজেকে ধরে রাখতে পারি না কিছুতেই।

মানুষের জীবনে হাজারো দিন থাকে। তার মধ্যে দু’একটা দিন থাকে মনে রাখবার মতো। অথচ, কী ফালতু জীবন আমার! সবচেয়ে জঘন্য দিনটাই আমার মনে রাখবার দিন।
এই দিনটা এলেই- একটা মায়াবী মুখ ভেসে উঠে চোখের কোনায়, মনের পাতায়।
আর তিনটে শব্দ এক আশ্চর্য সুর হয়ে কানে বাজে-
“ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি।”

আজ সাতটি বছর শেষেও শব্দটা কানের কাছ থেকে সরাতে পারিনি। কত দিন হারালো রাতের অন্ধকারে। কত রাত ফুরালো দিনের আলোয়। ফুরালো কত মাস। কেটে গেল সাতটি বছর। বদলে গেল কতকিছু! শুধু আমিই বদলাতে পারলাম না।

বদলাতে কি চাইনি আমি? 
চেয়েছি। চেয়েছি ভালোবাসার নেশাকে সিগারেটের আগুনে পোড়াতে। তার সাদা ধোয়ায় মিশিয়ে দিতে। পারিনি।

এমনকি এই সাত বছরে কমপক্ষে চারবার ভালোবাসতে চেয়েছি অন্যকোনো নারীকে। তাও পারিনি। যতবার অন্যকোনো নারীকে ভালোবাসতে চেয়েছি, চেয়েছি নিষ্ঠুর অতীতকে ভুলে গিয়ে বর্তমানকে ভালোবাসতে- ততবারই বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি-
একটা মায়াবী মুখ আমার চোখের কোনায়, মনের পাতায়। আর শুনতে পেয়েছি পাখির কন্ঠস্বর, একটা আশ্চর্য সুর আর পাগল করে দেওয়া তিনটে শব্দ ...

আহ! এই ফালতু জীবনে কী সুন্দর দিন ছিল আমার! তখন ছিল ২০০৬ সাল। সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমার চেহারা মোটেই সুন্দর নয়। চেহারার তুলনায় ছাত্র হিসেবে আমি ছিলাম আরও নিম্নমানের। আমি পড়তাম টাঙ্গাইল এম.এম.আলী সরকারি কলেজে।

আমার বড় ভাই তখন কেবল সিলেট এমসি কলেজে জয়েন করেছেন। ভাইয়ার কলেজ দেখা, গ্রীষ্মকালীন অবকাশ কাটানো এবং ভাইয়ার কাছে প্রাইভেট ব্যাচে গিয়ে পড়া- এই উদ্দেশ্যে সিলেট যাওয়া।

কিন্তু আমি ভুলেও ভাবিনি, স্বপ্নেও কল্পনা করিনি কোনোদিন- ওখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর একজোড়া চোখ, কিছু পাগল করা শব্দ- আর সেই চোখে, সেই শব্দে আমার জীবনের সর্বনাশ।

কতকিছু ভুলে গেছি এই সাতটা বছরে।
অথচ, সেইসব সোনালী সকাল, উদাসী দুপুর, বিষন্ন বিকেলগুলো আজো ভুলিনি।
কেন এমন হয়? যা ভুলতে চাই- তাই কেন মনে জাগে বারবার?

প্রথম যেদিন ভাইয়ার প্রাইভেট ব্যাচে পড়তে যাই, সেদিন রুমে ঢুকবার সময় একটা মেয়ে দেখি। মেয়েটির নাম জানতে পারি দু’দিন পর।
তবে তাকে দেখেই একটা নাম দিয়ে ফেলি আমি। নাম দেই ‘মায়া’।
মনে হয়েছিলো- পৃথিবীর সব মায়া লুকিয়ে আছে ঐ মুখে, ঐ চোখে।
                   
“লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট” এটা যে শুধু কথার কথা নয়- আমার প্রথম যৌবনেই তা টের পেলাম।

ভালোবাসা কি জিনিস- আমি আজো তা জানি না। এখনো বুঝতে পারি না। সহস্র মানুষের মতো আমার নিজের মনেও এই প্রশ্নটা বারবার জাগে-
ভালোবাসা কাকে বলে?

তবে একটা বিস্ময়কর পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম আমার মাঝে। দেখলাম, চারপাশের সবকিছু কেমন জানি রঙিন রঙিন। আকাশটা দেখি আরো বেশি নীল।ঘাসগুলো দেখি আরো বেশি সবুজ। নাম না জানা এক ভালো লাগায় ভরে যাচ্ছে মন।

প্রাইভেটের একটা ঘন্টা মনে হতো এক সেকেন্ড পরেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর বাকিটা সময় কাটতেই চাইতো না। শুধু প্রাইভেট পড়ার সময় তাকে দেখে দেখার তৃষ্ণা মিটতো না আমার।

তাই, প্রাইভেট পড়ার আগে এবং পরে ওকে দেখবার জন্যে চায়ের দোকানে বসে থাকতাম আমি। ওকে দেখার মাঝে ছিলো এক অজানা সুখ, ভরে যেতো বুক। মাঝে মাঝে বিকেলবেলা ওকে দেখার জন্যে ওদের বাসার রাস্তার সামনে করতাম অকারণ হাঁটাহাঁটি।

রাত্রিবেলায় যখন পড়তে বসতাম- তখন মাথাটা ফাকা হয়ে আসতো। অবাক হয়ে দেখতাম, শুধু মন জুড়ে নয়, মাথার ডানকোনায় একটা ফাকা জায়গা তৈরি হয়েছে। সেখানেও ‘মায়া’র অবাধ বিচরণ। সেই যে মন, সেই যে মাথার ডান পাশটা ফাকা হয়ে গেল- সেটা ভরাট হলো না আজও।

বইয়ের পাতাগুলো মনে হতো ওর মুখাবয়ব। আমি তাকিয়ে থাকতাম অনিমেষ। কিছুই মাথায় ঢুকতো না আমার। যে আমি কবিতা কোনোদিন লেখিনি- সেই আমার মধ্যেও দেখতাম কবি কবি ভাব। কবিতা লিখতাম এরকম-

মায়া,
সারাক্ষনই দেখি তোর ছায়া।
তোকে খুব ভালোবাসি ...
সারাদিন সারানিশি ...

এই যে আমি ওকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনে চলেছি। সকাল, বিকাল, রাতে মারা যাচ্ছি। মাঝে মাঝে একটুও ঘুমাতে পারছি না। এসবের কিচ্ছু কি ও টের পেত? ও কি বুঝতে পারতো- একটা মানুষ ওকে দেখবে বলে টানা দুই ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছে ছাদে কিংবা চায়ের দোকানে। হয়তো বুঝতে পারতো কিংবা পারতো না। কিন্তু এর কিছুই ওকে জানাতে পারিনি আমি।

কতবার মনে হয়েছে- প্রচন্ড সাহসী হই। লজ্জার মাথা খেয়ে ওর সামনে দাড়াই। তারপর গলা ফাটিয়ে বলি-
“I love you, Maya.......”  
কিন্তু কেন জানি এক অজ্ঞাত কারণে বলতে পারিনি।


একটা মাস যে এত অল্প সময়- তা আগে কখনো টের পাইনি। মনে হলো, তিন ঘন্টায় ফুরিয়ে গেল পুরো একটা মাস। এই একটি মাস আগেও মনে হতো- এই শরীর, এই মন আমার। কিন্তু টাঙ্গাইল ফিরে যাবার ক্ষণে মনে হলো- আরে, কিছুই তো আমার নয়।

একটা অন্তসারশূন্য শরীর গাড়িতে চেপে শা-শা করে ছুটে চলল টাঙ্গাইলের দিকে। আর একটা মন পড়ে রইল সিলেটে। দেখলাম- চোখজোড়া ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথার ডানপাশটা আরো বেশি ফাকা হয়ে আসছে ...

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু যে ট্র্যাজিক গল্পের নায়ক আমি- তাতে এত তাড়াতাড়ি গল্পটা ফুরিয়ে গেলে যে মানায় না। তাই, গল্প এগিয়ে চলে জীবনের মতোই ...



(পর্ব-২)
                                             
তারপর ...? 
তারপর আমার দিনগুলো কাটছিল বিষন্নতায়। আর রাতগুলো নির্ঘুম। হঠাৎ মধ্যরাতে ওকে স্বপ্নে দেখে জেগে উঠতাম আমি। বুকটা হু-হু করে উঠতো। দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তো জল। সারারাত ছটফট করেও ঘুমাতে পারতাম না।
এত ভালোবাসতাম কেন ওকে?
এর কোনো মানে হয়?
আর এত কষ্টই বা কেন ভালোবাসাতে?

কলেজে অনেক সময় অন্যকোনো মেয়েকে ওর মতো হাসতে দেখলে ঘোর লেগে যেত আমার।

কতবার ইচ্ছে করেছে হরিণের মতো ছুটে যাই, পাখির মতো উড়ে যাই ওর কাছে। মাঝে মাঝে টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম সিলেটের দিকে। বুকটা ভরে যেতো শূন্যতায় ...

দিনগুলো তবুও কেটে যাচ্ছিল- শুকিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া মাঠের মতো। হঠাৎ সেই মাঠে একদিন ভালোবাসার বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশটা হয়ে গেল আবার রঙিন। ঘাসগুলো হয়ে গেল আবার সবুজ। জীবন খুজে পেল- বেঁচে থাকার মানে।

একদিন একটা ফোনকল আসে আমার মোবাইলে। রিসিভ করেই একটা নারীকন্ঠ শুনতে পাই। মুহূর্তের উত্তেজনায় ভাষাহীন হয়ে পড়ি আমি। যার সাথে শত ইচ্ছে সত্ত্বেও সরাসরি কথা বলতে পারিনি। আরে, এটা যে তারই ফোন ...

ও সেদিন যা বলেছিলো- তা গুছিয়ে বললে এরকম:-

“তোমার মতো স্টুপিড আমি জীবনেও দেখিনি। গাধা, ভালোবাসতে গেলে একটু সাহসও থাকা চাই। কতবার ভেবেছি- তুমি বোধহয় আমকে ‘ভালোবাসি’ বলবে। অথচ, বলতে পারোনি। তুমি ঐ শব্দটা না বললেও- আমি ঠিকই বুঝতে পারতাম- তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো।

কেমন হাধারাম তুমি- যাবার আগে তোমার ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে আমার নাম্বারটা কালেক্ট করতে পারতে। অথচ, তা করোনি। আমি মেয়ে হয়ে- অনেক কষ্ট করে- কৌশলে তোমার ভাইয়ার কাছ থেকে তোমার কন্ট্যাক্ট নাম্বার কালেক্ট করেছি। যাকে ভালোবাসি- তাকে যদি ভালোবাসার কথা নাই বলতে পারি- তাহলে ঐ ভালোবাসার কোনো মানে নেই আমার কাছে। এখন থেকে এই নাম্বারটা সেভ করে রাখবে। সুযোগ পেলেই কথা বলবো আমরা।”

কথা শেষ হবার পর দেখলাম-
মাথার ডানপাশটা আর ফাঁকা নেই।
মনের কোথাও কোনো শূন্যতা নেই।
আহ! ভালোবাসা এত ভালো ...

তারপর থেকে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা হয়ে গেল আমার।

গল্পটা শেষ হতে পারতো এখানেও ...

প্রায় পাঁচটি মাস- প্রতিদিন প্রায় পাঁচ ঘন্টা কথা বলেছি আমরা। এমনও রাত গেছে- সারারাত কথা বলেছি। মোবাইলের ব্যালেন্স ফুরিয়ে যেত, ব্যাটারি লো হয়ে যেত কিন্তু কথা ফুরাতো না।
কী কথাই না বলতাম আমরা!

হয়তো জীবনের সব কথাই ফুরিয়ে ফেলেছিলাম ঐ পাঁচ মাসে। সুখের মুহূর্তগুলো কেন জানি খুব অল্প হয়। শেষ হয়ে যায় দ্রুত।

অতঃপর জীবনের সেই জঘন্য দিনটি এল।
১০ ডিসেম্বর, ২০০৬।
খুব ফুর্তি নিয়ে সেদিন ঘুম থেকে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম- আজ সকালে কথা বলার শুরুতেই দশটা চুমু দেবো ওকে। ফোনটা সেদিন ওই করেছিল এক অজানা নাম্বার থেকে। কান্না জড়ানো কন্ঠে ও বলেছিল-

“দেখো, গতকাল রাতে কথা বলার সময় আম্মু আমাকে সরাসরি দেখে ফেলেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে শুনেছে আমার সব কথাও। এতদিন কথা বলেছি চুরি করে। ভেবেছি- আম্মু বোধহয় টের পায়নি।

মোবাইলটা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বলেছে- আমাকে আর মোবাইল ব্যবহার করতে দেবে না। তুমি চিন্তা করো না জান- আমি খুব তাড়াতাড়ি একটা মোবাইল কিনবো। আম্মু সেটা জানবে না। বান্ধবীরা তো নয়ই। শুধু তুমি জানবে। যতক্ষন কলেজে থাকবো- ততক্ষন লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার সাথে কথা বলবো। আর যে পর্যন্ত মোবাইল না কিনতে পারছি- প্রতি সপ্তাহে দোকান থেকে হলেও কমপক্ষে পাঁচ মিনিট  করে কথা বলবো। একটি কথা মনে রাখবে- আমি তোমারই আছি। তোমারই থাকবো সারাজনম।”

এইসব বলে মায়া যখন ফোনটা রাখতে যাবে- তখন আহত হৃদেয় ওকে বলেছিলাম-
“জানি না এটাই শেষ কথা হয়ে যাবে কিনা। ভবিষ্যত অনিশ্চত। তবে ফোনটা রাখবার আগে ঐ শব্দটা কমপক্ষে তিনবার বলো- যে শব্দটা শুনলে একই সাথে বাঁচতে ইচ্ছে করে, আবার মরতেও ইচ্ছে করে।”

তারপর মনে হয়- পৃথিবীর সব ভালোলাগা নিয়ে ও তিনবার বলেছিল-
“ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি।”


একাকীত্ব
কিন্তু সেই সাতটা দিন আর ফুরালো না। মনে হতো- কালকেই সাতটা দিন শেষ হোক।
অবশেষে সাতদিন গেল। সাত মাস পেরোলো। ফুরালো আজ সাতটি বছর। অথচ, আমার নাম্বারে ওর ফোন আর এল না।

এখনো মাঝে মাঝে আননোন কোনো নাম্বার থেকে কল আসলে আতকে উঠি। ভাবি- এই বুঝি ওর ফোন এল। কতকিছু ঘটে গেল এই নষ্ট ভ্রষ্ট পৃথিবীতে- শুধু ওর ফোনটাই আর এল না কোনোদিন। আমি ওর নাম্বারে চেষ্টা করেছি বহুবার। কিন্তু নাম্বারটা বন্ধই পেয়েছি। হয়তো বন্ধই থেকে যাবে অনন্তকাল ...

এই যে ওর জন্য এতটা দহন- প্রেমানলে পুড়ে পুড়ে নিরন্তর কাবাব হয়ে যাওয়া- এক নাম না জানা বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া- এর কোনো মানেই অনেকে খুঁজে পাবে না।


কিন্তু কি করবো- আমি যে আজও তাকে ভুলতে পারি না। জানি- হয়তো ওর সাথে আমার দেখা হবে না কোনোদিন। এও জানি- আমার এই দহনের কথা ও কখনো জানতেও পারবে না। তবুও-
এখনো এই দিনটা এলে- মনটা ভীষণ এলোমেলো হয়ে যায়।
একটা মায়াবী মুখ ভেসে উঠে চোখের কোনায়, মনের পাতায়। আর তিনটে শব্দ কানে এসে বাজে ...

অতঃপর দেখি-
চোখজোড়া ভীষণ ঝাপসা।
মন আর মাথার ডানপাশটা একদম ফাঁকা ...

ওয়াদুদ খান 
সদরপুর, ফরিদপুর
লেখার তারিখঃ ১০ ডিসেম্বর, ২০১৩

[ধৈর্য সহকারে এতবড়ো গল্প পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনাদের সাড়া পেলে এরকম আরো লেখা পোস্ট দেওয়ার ইচ্ছে আছে। ]

0 মন্তব্য(গুলি):

Post a Comment