Monday, 9 April 2018

কোটা বিরোধী যোদ্ধা (মর্মস্পর্শী ছোটোগল্প)


দিন শেষে বিকেলটা বড়ো অপূর্ব লাগে। হয়তো জীবন সায়াহ্নটাও লাগে তেমনি আকর্ষ জাগানিয়া। সুন্দর বিকেলটা খুব দ্রুতই হারিয়ে যায় রাতের নিঃসীম গাঢ় অন্ধকারে। এই অদ্ভুত জীবনটাও তেমনি খুব দ্রুতই হারিয়ে যায় মরণ নামের এক অন্ধকার বলয়ে। ষাট বছর বেঁচে থাকা আসলেই বড়ো কম বেঁচে থাকা। 

হুমায়ূন আহমেদের একটা কথা মনটাকে মাঝে মাঝেই ভীষণ আলোড়িত করে- "একটা কচ্ছপ যেখানে অবলীলাক্রমে বেঁচে থাকে কয়েক শো বছর, সেখানে মানুষ নামের এই বিচিত্র প্রাণিটা কেন মরণের নিকষ কালোয় হারিয়ে যাবে ষাট কিংবা সত্তর বছর বয়সে? একটাই জীবন। অথচ, কতো ছোট্ট তার ব্যাপ্তি। 
তবুও তো কম বেঁচে থাকলাম না আমি।
মৃত্যুর সাথে নিরন্তর বসবাস করে আসা এই আমি দেখলাম- প্রায় ষাটটি বসন্ত।
ভাবা যায়?

যে দেশে মানুষ মরে গরুর চেয়েও অবহেলায়। সেই দেশে এতোটা বছর বেঁচে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। হঠাৎ মরণ নিয়ে এতো ভাবছি কারণে যে, আমি আমার মরণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি গতকাল গভীর রাতে।
প্রায় দুইমাস ধরে জন্ডিসে ভুগছিলাম। গ্রামের মুরুব্বিদের কথা শুনে প্রথমে কিছুদিন কবিরাজি চিকিৎসা করলাম। পানি পড়া, দই পড়া খেলাম। এমনকি গলায় ঝুলিয়ে দিলাম তাবিজ। না, কিছুতেই কিছু হলো না। সবার এক কথা- জন্ডিসের কোনো চিকিৎসা নেই। জাস্ট কমপ্লিট রেস্ট। লাগাতার ‍শুয়ে থাকা।  নানান প্রকারের শরবত আর ডাবের পানি খাওয়া। 
হলুদ রঙের সবকিছু খাওয়া নিষিদ্ধ।

কিছুদিন হোমিওপ্যাথিও চেষ্টা করে দেখলাম। কোনো উন্নতির লেশমাত্র নেই। যে যা বললো তাই করলাম। এমনকি একজন কবিরাজের কথামতো পুকুরে টানা দশদিন ডুব দিলাম খুব ভোরে। পাকা কলার ভেতরে জোনাকী পোকাও ভরে খেলাম তিন রাত্রি। আমার মতো কতো জন্ডিস রোগী এরকম অপচিকিৎসার শিকার হয়ে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে তার হিসেব কেউ জানে না। কোনো গতি না দেখে আবার এলোপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করলাম। 

অবশেষে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গেলো- আমাকে আক্রমণ করেছে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। দেখলাম পেটটা ক্রমাগত ফুলে উঠছে এবং লিভারে প্রচন্ড ব্যথা। শেষমেষ ঢাকা যাই। ঢাকা থেকে মাদ্রাজ। মাদ্রাজ থেকে আবার ঢাকা। ঢাকা থেকে শেষবারের মতো আবার ফিরে আসি গ্রামের বাড়িতে।  ফিরে আসা সুস্থ হয়ে ফিরে আসা নয়।  ফিরে আসা চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুর কাছে ফিরে আসা। নিরুপায় আত্ম সমর্পণ।  ফিরে আসাটা অচেনা, অজানা, অদেখা এক নতুন জগতে ফিরে যাবার জন্য। 

আমি যে মরে যাবো- একথা কেউ আমাকে বুঝতে দিতে চাচ্ছে না। সবাই বলছে মরা গাছে পাতা ধরবার মতো নতুন করে আবার সজীব হয়ে উঠবো আমি।

গতকাল গভীর রাতে অতি সন্তপর্ণে আলমারি থেকে আমার যাবতীয় রিপোর্ট বের করি রিপোর্টে যা দেখি তাতে হাসি পায় আমার। আমার লিভার সিরোসিস হয়েছে।সম্ভাব্য মৃত্যুর তারিখ ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭। 
একথা জানবার পরেই দেখলাম এই জঘন্য পৃথিবীটা বড়ো অপূর্ব লাগছে আমার কাছে।

মরে যাবো বলেই হয়তো নদীর ঘোলা জল, ইঁদুরের উৎপাত, কাকের কুৎসিত কা-কা শব্দ, এমনকি মাছির ভনভন গান- এক আশ্চর্য সুর হয়ে কানে বাজছে। যে জীবনটাকে মনে হতো বঞ্চনার, প্রতারণার, হতাশার, কষ্টের- আজ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনটাকে মনে হচ্ছে মধুময়। ইচ্ছে করে বেঁচে থাকি। বেঁচে থেকে দেখে যাই.........

কী দেখে যাবো?
কীইবা দেখবার বাকি আছে আমার? কম তো দেখলাম না।
কী পেয়েছি জীবনে?
বলবার মতো, মনে রাখবার মতো কিছুই কি পেয়েছি?
কেন জানি আজ জীবন নাট্যের শেষ অঙ্কে এসে কোনো হিসেব মেলাতে পারছি না। দুয়ে দুয়ে চার হলো না আমার জীবনে।

মরণের সাথেই যার বসবাস ছিলো একদা। অথচ, আজ সে মরণ দেখে ভীষণ ভীতু। বাঁচার নেশায় আজ সে দিশেহারা।  
স্মৃতির নদীতে সাঁতরাতে থাকি। চলে যাই ৪৬টি বছর আগে। সেই একাত্তরে। তখন এক টগবগে তরুণ আমি।বয়স আঠারোর বেশি হবে না। অনেক কিছু বুঝি। আবার অনেক কিছু বুঝিও না। তবে এতোটুকু খুব ভালো করেই বুঝতাম-
ওরা আমার মায়ের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।
তাই, একটি ফুলকে বাঁচাবার জন্যে, একটি নতুন কবিতা লেখার জন্যে- নাম না জানা হাজারো যুবকের মতো আমি আর বিপ্লব যুদ্ধে যাই। 
কী ভয়ংকর দিনই না ছিলো!

দাড়িয়াপুর পাহাড় সীমান্তে যুদ্ধ চলছিলো। সম্মুখ সমর। কান ফাটানো গুলির শব্দ। ভয়ার্ত আর্তনাদ। রক্তের হোলিখেলা। হাহাকার। চিৎকার। আমরা তখন অকুতোভয় সৈনিক। যুদ্ধ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পিছু হটে গেছে হায়েনার দল। আমরা ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময় দেখলাম- বিপ্লব একটা শব্দ করলো- আহ!
তারপর দেখলাম- ওর ঘাড়ের পেছনে গোল একটা গর্ত।
লুটিয়ে পড়লো বিপ্লব।
মুছে গেলো একটি নাম।
কতো সহজ ছিলো মৃত্যু। 
সেইসব দিনে। 

তারপর অনেক ভেবেছি- ঠিক ওইরকম আরেকটা গুলি বুকে লেগে যেতে পারতো আমার। আমিও মারা যেতে পারতাম বিপ্লবের মতো।
মারা গেলে হয়তো ভালোই হতো। এক অন্তহীন আশা নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে মরতে পারতাম আমি। অথচ, বিপ্লবের চেয়ে ৪৬টি বছর বেশি বেঁচে থেকে, ৪৬টি শীত, বসন্ত, বর্ষা বেশি দেখে কী লাভ হলো আমার?
আশা ফুরালো।
স্বপ্ন হারালো।
জীবনটা আবদ্ধ আজ নিরাশার বলয়ে।

স্বাধীনতার ৪৬টি বছর পরে এসে মনে হচ্ছে এই দেশটা চাইনি আমি। এই দেশের জন্যে সেদিন যুদ্ধে যাইনি আমি। আমরা। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় আজ আমি মুহ্যমান। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা আজ বড়ো কোনঠাসা। মুক্তিযোদ্ধা শব্দটা চলে গেছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে।

আমাদের গ্রামের খয়ের মুন্সি ছিলো নামকরা রাজাকার যুদ্ধের সময় অসংখ্য হিন্দু যুবতী মেয়েকে তুলে দিয়েছিলো পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে। এক গাল দাড়ি আর তসবি হাতে বলেছিলো, "ওরা হচ্ছে গনীমতের মাল। যুদ্ধের সময় সবই জায়েজ।"

এই বিশিষ্ট রাজাকার আজ 'খয়ের মুন্সি' থেকে হয়েছে 'বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা খয়ের উদ্দীন'
বীর মুক্তিযোদ্ধা খয়ের উদ্দীন কিছুদিন আগে গ্রামের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে।
ভাবা যায়?

একদিন আমার কাছে এসে বললো, কী খবর ভাই? ভালো আছেন?
আমি বললাম, হুম।
খয়ের রাজাকার একটা কুৎসিত হাসি দিয়ে বলতে থাকে- মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হচ্ছে। মাসে মাসে ভাতা দিবে। নামটা তালিকায় ওঠালাম। কমান্ডার ফজলুল হককে সাত হাজার টাকা দিতে হলো। দশ হাজার টাকা চাইছিলো। অনুরোধ করাতে তিন হাজার টাকা কম নিলো। আপনার নাম তো তালিকায় দেখলাম না। তাড়াতাড়ি নাম ওঠান। শুনলাম ভাতা-টাতা পাওয়া যাবে। চাকরিতে কোটাও নাকি দিবে।

এক অন্তহীন ঘৃণায় মুখটা বিকৃ হয়ে গেলো আমার। 
এই জন্যে সেদিন যুদ্ধে গিয়েছিলাম?
এই জন্যে?
এইসব রাজাকারের বাচ্চাদের মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধা দেবার জন্যে?
এইসব দেখবার জন্যে বেঁচে আছি এতোটা কাল?
এই মূল্য পেলো আমার বন্ধু বিপ্লবের তরতাজা একটা প্রাণ?   

 যে দেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ঘুষ খেয়ে চিহ্নিত খয়ের রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধা বানাতে পারে, সে দেশে আর কারো কাছে নীতি শব্দটাকে আশা করা বোধ হয় ঠিক না। ঘৃণার অনলে পুড়ে যাওয়া এই আমি- তাই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখাতে যাই না। 
কোনো ভাতা-টাতা পাবার আশায় তো সেদিন যুদ্ধ করিনি। যুদ্ধ করিনি কোনো কোটা খোটার জন্যেও। 

খয়ের রাজাকার মুক্তিযোদ্ধার হাসি হাসে। 
আর আমি মুক্তিযোদ্ধা থেকে হয়ে যাই একজন সাধারণ নাগরিক। 
আর আমার বন্ধু বিপ্লব হারিয়ে যায় আরো দূরে..........

এইতো কদিন আগে খয়ের রাজাকারের সাথে দেখা। তখনো আমার জন্ডিস হয়নি। রাজাকারটা আমাকে বললো, ‍"আপনাকে বললাম মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটটা নিতে। নিলেন না। এখন বুঝেন মজা! আপনার ছেলে রাশেদের এবারো বিসিএসটা হলো না। অথচ, আমার ছেলে কামাল এই বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রশাসন ক্যাডার পেয়ে গেলো।"

আমার ছেলে রাশেদ ভীষণ মেধাবী। কিন্তু ইদানীং সে ভীষণ হতাশাগ্রস্ত। পরপর তিনবার বিসিএসে ভাইভা দিয়েও কোনো ক্যাডার পেলো না সে। একদিন বাসায় ফিরে রাগ করে আমাকে বললো, "আমি আর বিসিএস টিসিএস দিতে পারবো না। সব চলে গেছে কোটা আর খোটার দখলে। পরে ওর লেখা একটা কবিতা আমাকে পড়ে শোনালো- 

এই দ্যাশ
এক্কেবারে শ্যাষ। 
মেধাবীরা ডুবছে কাদায়
চাকরি হচ্ছে কোটায় আর খোটায়। 
চাকরির বাজার আজ মামা আর চাচার দখলে
আসলের জায়গা নিছে নকলে। 
পরীক্ষা দিলেই এখন পাশ
অনেক আগেই হয় প্রশ্নপত্র ফাঁস। 
রাজাকাররা কার চালায়
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা শুধু গাল হাতায়। 
যাচ্ছে বাঁশ আজ দেশের পাছায়
তবুও বাঙালি বেঁচে থাকে মিথ্যে আশায়..."

কবিতটা শুনে খুব কান্না পেলো আমার। দরজা বন্ধ করে কতোক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। কী এক অন্তহীন ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, হতাশা নিয়ে আমার ছেলেটা দিন কাটাচ্ছে। কবিতার ভাষা অনেকের কাছেই নোংরা মনে হতে পারে। কিন্তু এই বর্তমান পরিস্থিতিই ওকে বাধ্য করেছে এসব লিখতে। আমি একজন বাবা। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। পরাজিত যোদ্ধা। লজ্জায় ওর সামনে ইদানীং দাঁড়াতেই পারি না। অপার সম্ভাবনাময় একটা ছেলে পানি না পাওয়া গাছের চারার মতো শুকিয়ে যাচ্ছে। মারা যাচ্ছে। একথা ভাবতে ভালোলাগে কোনো বাবার? এই তো সেদিন ওর মা আমাকে বললো, "জানো- রাশেদ তো চাকরির ধান্দা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দিয়েছে সব ধরণের জব স্টাডিও।" 

সেদিন ওর ডায়েরিটা হাতে নিই আমি। দেখি তাতে কোনো আশাবাদের কথা লেখা নেই। লেখা আছে হতাশার কথা। চরম ঘৃণার কথা। একটা পাতায় লেখা রয়েছে-
"ইদানিং ইচ্ছে করে বিসিএস ক্যাডার নই, হয়ে যাই সন্ত্রাসী ক্যাডার। কারণ, সন্ত্রাসীরাই সব ক্যাডারের বাপ। ইচ্ছে করে খুন, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কিডন্যাপ ইত্যাদিকে নিই ক্যারিয়ার হিসেবে। সাফল্যের আকাশে ওঠার সিঁড়ি আজ নীতি নয়। দুর্নীতি। যারা দুর্নীতিবাজ, চোর, বদমাশ- সম্মান আজ তাদেরই বেশি। তাই মাঝে মাঝে মন চায়- কলমটা হাত থেকে ফেলে দিই। হাতে তুলে নিই অস্ত্র। নষ্ট হলে ইদানীং কেষ্ট মিলে। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে না আর।"   

পড়ি আর দেখি আমার মনটা সুতোর মতো ছিড়ে যাচ্ছে। 
শত টুকরো হয়ে যাওয়া মন নিয়ে ভালো কিছু ভাবার, ভালো কোনো স্বপ্ন দেখার শক্তি হারিয়ে ফেলি আমি। আজ এই নিষ্ঠুর বর্তমানের সামনে দাঁড়িয়ে সেই ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বড়ো বেশি অকারণ মনে হয়। প্রশ্ন জাগে, এভাবে ত্রিশ লক্ষ লোকের শহীদ হওয়া এবং দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর কোনো মানে ছিলো কি? 

আজও মন্দির ভাঙে। 
পতাকাটা আজও খাবলে খায় সেই পুরনো শকুন। 
গুড়িয়ে দেয় শহিদমিনার। 
আজো সুধাংশুরা চলে যায় এদেশ ছেড়ে। 
সিঁথির সিঁদুর মুছে যায় হরিদাসিদের... 

রাশেদের ডায়েরীর পাতা উলটাতে থাকি। 
আর দেখি অন্তহীন ক্ষোভ ঝরে পড়েছে প্রতিটা পাতায় পাতায়। 
এক জায়গায় লেখা-

"রাজাকাররা আজ ফুলে কলাগাছ,
খায় ওরা রুই কাতলা মাছ,
হরতালে অবরোধে ওরা কাটে গাছ
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে 
কোটায় নিচ্ছে জব 
ভাতা-টাতা সব।  

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পেট ঠেকেছে পিঠের সাথে
জোটে না নুন তাঁদের পান্তা ভাতে। 
ইচ্ছে করে তাই-
আগুন ধরাই
পুড়াই, সব পুড়াই... 

তারপর খাই গুলি
উড়ে যায় যাক না আমার মাথার খুলি। 
হয়ে যাই লাশ
আমার লাশ হোক এক নয়া ইতিহাস...

আমার লাশের মূল্যে দূর হোক 
যত কোটা-খোটা বৈষম্য 
সুযোগের সমতাই হোক নতুন দেশের ধর্ম..."  

আবোল তাবোল ছন্দে লেখা কবিতাগুলোই আমার কাছে পায় এক অনন্য সাহিত্যের মর্যাদা। এভাবে একটা উদীয়মান সূর্য অন্ধকার মেঘের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে দেখে মনটা কেমন জানি ফাঁকা হয়ে আসে। 

যে ছেলেটা এখন বিসিএস ক্যাডার হয়ে নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখার কথা, সেই ছেলেটা এখন কী সব কবিতা লিখছে? ওর মতো বয়সী একটা ছেলে লিখবে প্রেমের কবিতা। ওর কাছে মনে হবে আকাশটা গাঢ় নীল। ঘাস আর গাছগুলো ওর কাছে মনে হবে গাঢ় সবুজ। পাখিদের মনে হবে একটু বেশিই নীড়মুখী। অথচ, এক নীড়হারা পাখির মতো ফালতু একটা আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে রাশেদ। 
একটা স্বপ্নহীন জগতে ওর সারাক্ষণ বসবাস। 
আহ! মাথাটা ধরে আসে আমার। 

কয়েকটা দিন পরেই মরে যাবো আমি। জানি না- ২০১৮ সাল দেখে যেতে পারবো কিনা। কীইবা হবে নতুন একটা সাল দেখে?
যেখানে গত ৪৬টি বছরেও আমাদের পেটের মুক্তি মেলেনি, মেলেনি মনের মুক্তিও, সেখানে আগামী দিনে কী যে মিলবে তা সহজেই অনুমেয়। 

পুরো পৃথিবীটা কেমন জানি ধূসর মনে হয়। মনে হয়, চারপাশ নিকষ কালো। গভীর অন্ধকার। সব কিছু মনে হয় অর্থহীন। 
অর্থহীন মনে হয়, এতোটা বছর বেঁচে থাকা। আবার মরে যাওয়াও। 

গভীর মর্মবেদনা নিয়ে বাইরে বের হই... 
দেখি উপরে বিশাল আকাশ। গাঢ় নীল। দূরে একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে। বাড়ির পাশেই একটা নদী। তাতে ঘোলা জল। 
কেন জানি জীবনের শেষ কিনারে দাঁড়িয়ে এই নদীর ঘোলা জল, উপরের গাঢ় নীলাকাশ, পাখির কিচিরমিচির- সবকিছুর প্রতিই সুতীব্র টান অনুভব করছি। বাঁচতে ইচ্ছে করছে পাগলের মতো।

"একটা গোলাপফুল কীভাবে ফোটে? আবার সেই ফুটন্ত গোলাপ  কীভাবে ঝরে যায়?"-এই দুঃসহ দৃশ্য দেখার জন্য অন্তত বেঁচে থাকতে চাই না।  

হতাশার মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে সীমানার ওপারে যাবার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি..............

লেখার তারিখ: ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৭

লেখা: ওয়াদুদ খান 

      

Friday, 30 March 2018

কিছু লোকে ধর্ষক; বাকি সবে দর্শক

ভুল করে চোখ যদি পড়ে যায় খবরে
মন বলে যাই চলে আন্ধার কবরে।
এ-কি হাল হয়ে গেল আমাদের দেশটার?
মেয়েদের লুটে খায় ড্রাইভার, হেল্পার।
ক্ষমতায় নারী তবুও নারীরাই অসহায়
ধর্ষণ বাড়ছেই যত দিন-রাত যায়।
ফেসবুকে হাহাকার তাতে ওরা দমে না
শাহবাগে জমলেও ওরা তবুও থামে না।

দেশ এখন দুইভাগ, একভাগে ধর্ষক
বাকি যারা নিরীহ, তারা সবে দর্শক।
শিশু কি-বা বুড়ো হোক নারী যদি জুটে যায়
বাসে কি-বা মাইক্রোতে ওরা মজা লুটে খায়।
ধর্ষক হাওয়া খায় জেলে কি-বা জামিনে
জনতারে মারে প্যাচ এদেশের আইনে।

এই দ্যাশ, আজ শ্যাষ কোথা গেলে আলো পাই?
মন্দে সয়লাব, কোথা গেলে ভালো পাই?

ওয়াদুদ খান
০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

Monday, 26 March 2018

Monday, 19 March 2018

ফ্যান্টাসি-১ (একটি বিশুদ্ধ ভালোবাসার গল্প)


কিস্তি-১৭

বিষণ্ণ বিকেল।
জেনির উদাসী মন। 
কীভাবে দেখতে দেখতে পার হয়ে গেলো অনার্সের চারটি বছর। 
কীভাবে কীভাবে যেনো জয়ের সাথে আটকে গিয়েছিলো জেনি। স্মৃতির পাতায় সেটা আজও অম্লান। 

জয়ের সাথে জেনির পরিচয় ফেসবুকের কল্যাণে। 
আতিক ছিলো জেনির ফেসবুক ফ্রেন্ড। 
জয়ের একটা স্ট্যাটাস শেয়ার করেছিলো আতিক। 
তাতে লেখা ছিল:-
মাইয়া শোনো, তুমি কি খুউব হতাশাগ্রস্ত? তোমার বান্ধবীরা রোজ প্রপোজ পাইতাছে বাট তুমি পাইতাছো না। কোনো প্রোব্লেম নাই বালিকা। আমাকে তোমার ফ্রেন্ডলিস্টে অ্যাড করো। 
কথা দিচ্ছি- প্রথম চ্যাটিং-এ তোমাকে প্রপোজ করবো আমি। প্রপোজ করবার মতো সাহস এবং অভ্যাস দুটোই এই সভ্য ছেলের আছে। ফীলিং একা একা আর ভালোলাগে না অ্যাট প্রেমনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
স্ট্যাটাস পড়েই কৌতুহল জাগে জেনির। তাড়াতাড়ি- জয়ের প্রোফাইলে ঢুকে ও। 
ও বাব্বা! 
এতো সুন্দর চেহেরা কোনো ছেলের হয়! 
কী স্মার্ট লুক! 
মায়াবী চোখ। 
কিন্তু ছেলেটা এতো অসভ্য কেনো? নিশ্চিত প্রেমের সেঞ্চুরি করা ওর লক্ষ্য। 
যাক একটু টাইম পাস করে দেখি- কেমন ছেলে ও। 

জয়ের প্রোফাইলের অ্যাবাউটে লেখা ছিলো:-
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি...............
যদিও জানি- নাটোরের বনলতা সেন আমাকে দুদন্ড শান্তি দিবে না।
তবুও, হাঁটিতেছি পথ........................ 
মনে হয়, এই অ্যাবাউট পড়াটাই ওর কাল হয়ে গিয়েছিলো। 

ওদের প্রথম দিককার চ্যাটিং জয় ভুলে গেলেও, জেনি একটুও ভুলেনি। এখনো মনে পড়ে......... 
- হাই, ম্যাম আপনি কি রেডি?
- কথা নেই, বার্তা নেই জিজ্ঞেস করছেন রেডি কিনা? 
- আপনি অ্যাড করেছেন। আমার শর্ত মেনেই নিশ্চয় করেছেন।
- কী শর্ত? কখন দিলেন?
- আজব। আমার স্ট্যাটাসে বলা ছিলো- আমি প্রপোজ করবো। মনে নাই। 
- ওহ! আচ্ছা, আপনার কি সেঞ্চুরি করা লক্ষ্য? কতো রান করেছেন? 
- বুঝতে পারার জন্যে ধন্যবাদ। আপনাকে প্রপোজ করলে বিরাশি রান হয়।  গত রবিবারে পূর্ণ হয়েছে একাশিতম.............. 
- লজ্জা করে না আপনার?
- দেখুন, লজ্জা করবে কেনো? এমনো তো হতে পারে- এ পর্যন্ত আপনি একাশিবার প্রপোজ পেয়েছেন- আমার প্রপোজে আপনার বিরাশিকলা পূর্ণ হবে। 
- বিরাশি কলা? এখানে কলা কোথা থেকে আসলো?
- ষোলোকলা শুনেছেন তো। ষোলোকলা অনেকেরই পূর্ণ হয়। আপনার না হয়- একটু বেশি কলা পূর্ণ হোক। একশ কলা পুর্ণ হোক আপনার। ওকে আপু। রেডি হন। প্রপোজ করছি............ 
- সত্যি সত্যি প্রপোজ করে ফেলবেন? চেনা নেই, জানা নেই......... 
- হুম করবো। 
- ওকে। করেন। 
জেনি এটা মজা করে বলেছিলো। জয়ের উত্তর শুনে সে অবাক না হয়ে পারলো না। 
- আমি আপনাকে প্রপোজ করছি- আপনি কি আমার ফ্রেন্ড হবেন? ফ্রেন্ড? হুম, ফ্রেন্ড হবেন? 

জেনি মনে মনে যা ভেবেছিলো- জয় সেটা বললো না। 
আর জয় তো তার স্ট্যাটাসে লিখেছিলো- সে প্রপোজ করবে। 
প্রেমের প্রপোজ করবে- সেটা তো বলেনি। 
বন্ধুত্বের প্রপোজও যে হতে পারে- জেনির সেটা মাথায়ই ঢুকেনি। 

তারপর থেকে প্রায় চারটা বছর জয়ের কথার বৃষ্টিতে জেনি ভিজে যাচ্ছে অবিরাম। 
জয় এক কথার আকাশ। 
জয়ের আকাশে শুধু কথার মেঘ। আর কথার বৃষ্টি।  
কতো কথা জানে জয়। 
কতো কথা! 

ওয়াদুদ খানের সর্বাধিক পঠিত উপন্যাস "ফ্যান্টাসি-১"... 

সম্পূর্ণ উপন্যাসটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে...
(Click here to Download the full novel)

Thursday, 8 March 2018

ফারিহা, শুধু তোমার জন্য (একটি অকবিতা)


ও য়া দু দ     খা ন

ফারিহা,
তুমি যখন ক্লাস সেভেনে
এতোটা পবিত্র লাগতো তোমায়
মনে হতো-
তোমাকে মানায় ঐ হেভেনে।

ভাবতাম-
তুমি বড়ো হলে
আমার নিখাদ বিশ্বাস
আর এক আকাশ ভালোবাসা
তোমার মনের সিন্দুকে জমা রেখে দেবো।

সেই তুমি-
চুপচাপ কবে বড়ো হলে জানলামই না।
অবাক হয়ে দেখলাম-
তুমি যখন ক্লাস নাইনে
অনেক আপাত সুশ্রী ছেলে
আছে তোমার লাইনে।

তোমার দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া
এ হাধারাম প্রেমিকের কীইবা করার ছিল?

জানো ফারিহা,
তুমি যখন উঠে গেলে ক্লাস টেনে
কতোবার ভেবেছি-
ভালোবাসা দিয়ে
তোমাকে নিয়ে আসি এ বুকে টেনে।

হঠাৎ শুনলাম-
তুমি ঢাকা চলে গেছো।
ঢাকা গিয়ে
লাল, নীল, সবুজ বাত্তি দেখে
তুমি বদলে গেলে আমূল।
প্রথম মাসেই খবর পেলুম-
তোমার হাতে এক নবাগত প্রেমিকের হাত।
দুমাস পরেই নাকি দেখা গেল অন্য আরেক যুবক।

ফারিহা,
তুমি এভাবে নষ্ট হবে
কোনোদিন ভাবিনি
এতো ভালোবাসার জলে কাটবে সাঁতার
মাথায় আসেনি।
ভার্সিটির ছয় বছরে নাকি
ডজনখানিক প্রেম হলো তোমার।

নিত্য নতুন প্রেমে
কিছু সুখে কিংবা অ-সুখে
কাটলো তোমার সময়।
সেদিনের সেই গ্রাম্য সরল বালিকা
হয়ে গেলে ঢাকার জনপ্রিয় প্রেমিকা।
আমার মতো আবালের খোঁজ
তুমি রাখবে কখন?
রাখবে কেন?

ঢাকায় আমিও ছয়টা বছর ছিলাম।
ঢাকার অলি-গলি, নর্দমায়
নোংরা ভালোবাসার পুঁজে
খুঁজে নিতে চেয়েছিলাম নিষিদ্ধ সুখ।
কিন্তু ফারিহা,
তোমার খবর রাখা ছাড়া এই আতেল প্রেমিক
আর কিচ্ছু করেনি।

জানো না তো............
আমিও তোমার মতো নষ্ট হয়ে গেছি।
তোমার অবক্ষয়ের খবর পেয়ে 
বিড়ির বিচ্ছিরি ঠোঁটে চুমু খেতে খেতে
আমার দুঠোঁট নিকষ কালো হয়ে গেছে।
মলিন অ্যাশট্রেতে জমা রাখি
আমার নষ্ট জীবনের বিশুদ্ধ ভালোবাসা...............

লেখা: ওয়াদুদ খান
১৯ মে, ২০১৫
সদরপুর, ফরিদপুর