Tuesday, 29 August 2017

অকারণ মরণ (এক মেধাবী ছাত্রের ঝরে যাওয়ার কাহিনি)

আছি
মৃত্যুর কাছাকাছি
যাবো চলে
সব ফেলে
ঐ দূর পরপারে
কেউ কি খুঁজবে আমায়
রাতের অন্ধকারে? 

এখান থেকে শুরু


পর্ব-১


অবশেষে মরণ হলো আমার।
পৃথিবীতে কেউ অমর নয়। তাই, আমি যে মরলাম- এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এইভাবে এত তাড়াতাড়ি মরতে চাইনি আমি।

আমি যখন পৃথিবীতে আসি তখন কেউ খুশি হয়েছিল এমনটা শুনিনি। বরং রাগে, অভিমানে সেদিন বাবা নাকি বাড়িতেই আসেনি। কারণ, আমাদের ঐ নিম্নবিত্ত পরিবারে আমার আগে আরও চারজন জায়গা করে নিয়েছিল। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’- এমন সংসারে আমার জন্মগ্রহনটা শুধু সংখা বৃদ্ধিই ঘটিয়েছিল।

যার আগমনে যেখানে এই পৃথিবীর কারও কোনো আনন্দ নেই, তার চির প্রস্থানে পৃথিবীর  কারও এতটুকু দুঃখ থাকবে না- সেটা খুব ভালো করেই জানতাম আমি। বাঁচার নেশা ছিল আমার মদের নেশার চাইতেও বেশি।

প্রায়ই ভাবতাম -
কী হবে মরে গিয়ে?
কে ছাড়বে দু’ফোটা জল আমার জন্যে?
কে ছাড়বে একটু দীর্ঘশ্বাস?
যার বেঁচে থাকায় এই পৃথিবীর কিছু যায় না, আসে না। তার মরণেও এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর কিছু যাবে না, আসবে না- এটাইতো স্বাভাবিক।

কী ফালতু জীবন আমার!
বেঁচে থাকায় কোনো আনন্দ নেই।
মরণেও যেন এতটুকু স্বান্ত্বনা নেই।
বহতা নদীর মতো অকারণ ছুটে চলা।
আর সাগরের অন্তহীন জলরাশির সাথে মিশে নিজেকে হারিয়ে ফেলা।

তবুও- জীবনটা কেন জানি মনে হতো ভীষণ সুন্দর। রোমাঞ্চকর। তাই, মরে গিয়ে- হেরে যেতে চাইনি আমি। হয়তো এই সুতীব্র বাঁচার নেশাটাই- মৃত্যুকে আকর্ষণ করেছিল বেশি।

আমি সুকান্ত নই। নই শেলী, কীটস কিংবা বায়রন। বয়স তাই তেইশ পেরিয়ে গেলেও, এমন কিছু করতে পারিনি- যার জন্য মরণের পরেও কেউ মনে রাখবে আমায়।

ছোটোবেলা থেকেই কবিতা লেখার খুব নেশা ছিল আমার। ভেবেছিলাম- বড়োমাপের একজন কবি হবো আমি। কবিতাও লিখেছিলাম অনেকগুলো। একটি কবিতা আজও মনে পড়ে। তবে কবিতার নামটা মনে নেই।

আছি
মৃত্যুর কাছাকাছি
যাবো চলে
সব ফেলে
ঐ দূর পরপারে
কেউ কি খুঁজবে আমায়
রাতের অন্ধকারে?

মাগো তুমি হীনা

কেউ মনে রাখবে কিনা
জানি না।

আজ নয় কাল

হয়ে যাবো একদিন স্মৃতির আড়াল
সাগরের এক ফোঁটা পানির মতো
ফুরিয়ে যাবো
হারিয়ে যাবো
কেউ জানবে না।
কেউ জানবে না।

এমন ছাইপাশ আরও অজস্র কবিতা।
কিন্তু এক সন্ধ্যায়-
এক মেয়ের সাথে অভিমান করে সমস্ত কবিতা এক পুকুরে ফেলে দিয়েছিলাম। কবিতার খাতার মতো আমার ভিতরকার কবি মানুষটাও সেদিন পুকুরে ডুবে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।

তারপর আর কখনো চাঁদের দিকে তাকিয়ে কোনো মুখ দেখতে পাই নি আমি। মেঘের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাইনি কোনো ঘন কালো চুল। ফুলের দিকে তাকিয়ে মনে হয়নি- কারো মন ফুলের মতো সুন্দর।

তবুও জীবন এগিয়ে চলছিল। অর্থহীন এক পরিনামের দিকে। দেখতে দেখতে অনার্স তৃ্তীয় বর্ষে পা রাখলাম আমি।


পর্ব-২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম আমি। মরণ দেখে ভীষণ ভীতু এই আমি ঢাকা শহরের মূল রাস্তায় বের হতাম কম। হরতাল কিংবা হরতালের আগের দিন- সারাটাদিন রুমে বসে বই পড়তাম। কারণ, প্রতিটা হরতালে অনেক নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছিল।

সেদিনের সকালটা ছিল চমৎকার। রোদ্রকরোজ্জ্বল। মনটাও ছিল ফুরফুরে। পকেটে ছিল সদ্যপ্রাপ্ত টিউশন-ফির হাজার পাঁচেক টাকা। একটা রিকশা ভাড়া করে মতিঝিল যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কেন জানি ঢাকা শহরটা খুব সুন্দর লাগছিল। এই নোংরা শহরটাকে এত ভালো আগে কখনো লাগেনি তো!

মতিঝিল শাপলা চত্বরে নেমেই থমকে দাঁড়াই। একি শুরু হয়েছে এখানে! একদিকে জামাত শিবিরের জঙ্গী মিছিল ধেয়ে আসছে। তাদের সবার হাতে লাঠি আর ইটের টুকরো। অন্যদিকে তাকিয়ে দেখি শত শত পুলিশ।

আজ তো হরতাল নয়। তাহলে হঠাৎ কী শুরু হলো এখানে! দেখি শিবিরের লোকজন ‘নারায়ে তাকবীর- আল্লাহু আকবার’ বলে নির্বিচারে গাড়ি ভাঙছে। পোড়াচ্ছে। ছুড়ে মারছে ইটের টুকরো। আর পুলিশ বাহিনি ছুড়ছে কাঁদানে গ্যাস, জল কামান আর রাবার বুলেট। আমি ৭১ দেখিনি। দেখেছি ২০১৩। মনে হচ্ছিল আরেক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে এখানে।

অকারণ মরণ


আমি ঢাকা শহরের অলি গলি তেমন চিনি না। কোথায় পালাবো বুঝতে পারার আগেই দেখি- আমার কপালের এক কোণা বেয়ে রক্ত ঝরছে। দু’হাত দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। তখন আর একটা শব্দ এল কানে.........

দেখলাম- বুক বরাবর কি যেন একটা ঢুকে গেলো। হঠাৎই ঘোর লেগে গেল চোখে। দেখি- বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর আমার দু’চোখের সামনে- চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাওয়া আমার বাবার মুখখানা.........

তারপর যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম- ততক্ষনে মরণ হয়ে গেছে আমার। প্রায় আট ঘন্টা জীবনের সাথে যুদ্ধ করে গভীর রাতে হেরে যাই আমি। তবে মরে গিয়ে দেখলাম- আমি মানুষটা অতো কম দামী নই। পঁচিশ হাজার টাকার একটা চেক পেয়েছে আমার পরিবার। খারাপ কি আমার জীবনের দাম?

যে আমি এদেশের রাজনীতিকে ‘গু’ এর চাইতেও বেশি ঘৃ্না করতাম- মরণের পরে দেখলাম- সেই আমি নাকি শিবিরের একজন ত্যাগী কর্মী। আমি নাকি শহিদ হয়ে গেছি।

আবার দেখলাম- ছাত্রলীগ বলছে, "আমি নাকি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমি নাকি মুজিব সেনা।"
আমার বিধবা মায়ের সারা জীবনের কষ্ট। তার শখের সোনার হার বিক্রি করে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা। আর কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করে শেয়াল ডাকা রাত্তির পর্যন্ত- নিরন্তর ক্লাশ, টিউশন কিংবা  বই পড়ায় মগ্ন থাকা- সবই ব্যর্থ হয়ে গেল কয়েকটি ইটের টুকরো আর একটা বুলেটের কাছে। মুহূর্তেই।

একটা মোবাইল নাম্বার বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে। চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। এরকম বন্ধ হচ্ছে প্রতিদিন। তাই পৃথিবীর কিছু এল না। কিছু গেলও না।
ভেবেছিলাম- মরণের পর কারো মনের পাতায় কিংবা কারো লেখার খাতায় ঠাঁই হবে না আমার। অবাক হয়ে দেখলাম- পরের দিন বেশ কয়েকটি পত্রিকায় ছোটো করে হলেও জায়গা পেয়েছি আমি। কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম ছিল এমন-

(১) "শাহাদাত বরণ করলেন আরেক শিবির নেতা”- দৈনিক চার দিগন্ত
(২) “শিবিরের হামলায় প্রাণ গেল আরেক মুজিব সেনার”- দৈনিক মানুষকন্ঠ
(৩) “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র খুন”- দৈনিক ভোরের আলো

তারপরের দিন- খবরের পাতা ভরে গেল অন্যসব নতুন খবরে।
আর আমি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলাম মহাশূন্যে। ধোঁয়ার মতো...............

লেখা: ওয়াদুদ খান
কবি ও কথাশিল্পী

[লেখার প্রেক্ষাপট: ২০১৩ সালের (সমকালীন) রাজনীতি
লেখার তারিখ: ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৩]

0 মন্তব্য(গুলি):

Post a Comment