Saturday, 18 August 2018

কুরবানিও ফ্যাশন এখন | রম্য কবিতা

কু র বা নি

ও য়া দু দ   খা ন

কুরবানি আজ ত্যাগ বোঝায় না
বোঝায় তোলা সেলফি
ট্যাগ করা হয় বন্ধু-স্বজন
দেখ রে গরু কিনছি।

কুরবানি আজ হইছে ফ্যাশন
ফেবুর লাগি স্ট্যাটাস
আমার গরু এত্ত বড়ো
খাচ্ছে ভুষি, খাচ্ছে ঘাস।

কুরবানি আজ লোক দেখানো
সমাজ জুড়ে কম্পিটিশন
তোমার গরু পিচ্চি এত-
আমার গরু মোটকু ভীষণ।

কুরবানিআজ ফ্রিজমুখী
গরিব-দুখির অংশ নাই
বছর জুড়ে মাংস খাওয়া
নিয়ত ছহির বংশ নাই।

কুরবানি আর কুরবানি নাই
হয়ে গেছে ট্র‍্যাডিশান
ঋণ করে তাই- কুরবানি চাই
রাখতে বংশের সম্মান।

আজকে যারা কুরবানিতে
খাচ্ছে গরুর মাংস,
ভুলে গেছে তাদের কাছে
আছে গরিবের অংশ।

কবিতা লেখার তারিখ ও সময় 
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
সকাল: ৮:৫৪

কু র বা নি | ত্যা গ | S A C R I F I C E... (অসামান্য আলোচনা)

কুরবানির গরু (প্রতীকী)

ধনাঢ্য মুসলিমদের উপর আল্লাহ তা'আলা কুরবানিকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন (ওলামায়ে কেরামের এমনটাই অভিমত)। কুরবানি মানেই হচ্ছে ত্যাগ। বাংলায় প্রচলিত, "ভোগে সুখ নাই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।" এখন, প্রশ্ন জাগতে পারে, "কুবানিতে কী ত্যাগ করছেন ধনাঢ্য মুসলিম? কুরবানি তো ভোগেরই আরেক নাম!"
সত্যি বলতে কি, বর্তমানে ইসলামের প্রকৃত চর্চা নেই বলে, কুরবানিকে আর ত্যাগ বলে মনে হয় না কারও। বরং লোক দেখানো এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা বলে দৃশ্যমান হয়।

সেলফিস্টিক হাতে নিয়ে গরুর গলা ধরে যখন কোনো মুসলিম তরুণ কিংবা তরুণী ফেসবুকে পিকচার আপলোড দেয়, তখন কুরবানির মর্মবাণীকে যেন উপহাসই করা হয়।
সেলফি তোলার প্রতিযোগিতা চলছে  

কিছু লোক নিজেদেরকে আরও ধনবান প্রমাণের আশায় উচ্চমূল্যে গরু কিনে কৌশলে জাহির করার ধান্দায় থাকে। কুরবানির হাটে কিংবা ঈদের মাঠে এঁদের সরব উপস্থিতি থাকলেও, দিনান্তে মসজিদে একবারও দেখা যায় না। নামাযের কথা বললে, এঁদের 'গ্যাস্ট্রিক, পেট ব্যথা' বেড়ে যায়। কুরবানির গরুর গলায় লাল মালা পরিয়ে মহল্লাতে চক্কর দেয়। কেউ জিজ্ঞেস না করলেও কৌশলে বলে, "দাদা, এক লাখ পঁচাত্তর হাজার টাকা দিয়ে কিনলাম। কেমন হলো?"

মনে রাখতে হবে, কুরবানির কবুলিয়াতের শর্ত হচ্ছে সহীহ নিয়্যত। অন্তরের খবর অবশ্যই আল্লাহ তা'আলা জানেন। এ বিষয়ে সন্দেহ থাকলে কুরবানি করার দরকার কী?    আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে বলেন:-
﴿ لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٣٧ ﴾ [الحج: ٣٧]
অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কুরবানির পশুর) না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিঁনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পারো, এজন্য যে, তিঁনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, কাজেই সৎকর্মশীলদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও। [সূরা হাজ্জ:৩৭]।
কুরবানির গোশত আল্লাহ তা'আলার কাছে পৌঁছে না। মানুষের কাছেই পৌঁছাবে। মানুষই খাবে। তাই বলে, যিনি কুরবানি দিচ্ছেন, তিনি একাই সারাবছর খাবেন, আর পাশের গরিব প্রতিবেশী ঈদের দিন গোশতের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরবেন, তা তো নয়। আমার প্রতিবেশীর খোঁজ রাখার নৈতিক দায়িত্ব আমারই। তাকে কেন আমার দ্বারে আসতে হবে? আমি তার দ্বারে গিয়ে দিয়ে আসলে সমস্যা কোথায়? 
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন-
﴿ فَكُلُواْ مِنۡهَا وَأَطۡعِمُواْ ٱلۡبَآئِسَ ٱلۡفَقِيرَ ٢٨ ﴾ [الحج: ٢٨]
‘অতঃপর তোমরা তা হতে আহার কর এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।’ [সূরা হাজ্জ:২৮]।
একদম সাদামাটাভাবে বুঝা যাচ্ছে, যিনি কুরবানি দিবেন, তাঁর জন্য গোশত খেতে মোটেই আপত্তি নেই। খেতে যখন মহান আল্লাহ তা'আলা নিষেধ করছেন না, তখন সেটা মেনে নিতে সবাই বাধ্য। কিন্তু, 'দুঃস্থ ও অভাবগ্রস্তকে আহার করাও'- এই অংশের দিকে অনেকেরই দৃষ্টি থাকে না।
ঈদুল আযহার আগে ফ্রিজের বিক্রি বেড়ে যায়। এর কারণ, ধনাঢ্যরা কুরবানির গোশত সংরক্ষণ করতে চায়। অনেকে গর্ব করে বলেও থাকেন, "আরে, গত কুরবানির গোশত তো এই কুরবানিতেও শেষ হয়নি।" গোশত খাওয়াই যদি উদ্দেশ্য হবে, তবে কুরবানির দিন গরু যবেহ না করে, বছরের যেকোনো দিন করলেই হয়।
যারা বছরজুড়ে কুরবানির গোশত ফ্রিজিং করে খান, তাঁরা নিচের হাদিসটি দলীল হিসেবে পেশ করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরবানীর গোশত সম্পর্কে বলেছেন-
«كلوا وأطعموا وادخروا»
‘তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর।’ [বুখারী, হাদীস নং ৫৫৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৭১]
হাদিসে তো সংরক্ষণের কথা বলা আছে। তাহলে, সংরক্ষণ করলে দোষ কোথায়? দোষ নেই। হাদিসে এটাও আছে,'অন্যকে আহার করাও'- সেদিকে দৃষ্টিপাত করেছেন কি? অন্যকে আহার করানোর পরে যদি সংরক্ষণ করতে চান, তবে না বলার সুযোগ নেই।
কেউ যদি, কুরবানির সবটুকু গোশত গরিব দুঃখীর মাঝে বণ্টন করে দেন, তাতেও কিন্তু ওলামায়ে কেরামের আপত্তি নেই (অবশ্যই ইসলামের দৃষ্টিতে)। এমনকি, ওলামায়ে কেরাম এটাও বলে থাকেন, আপনার প্রতিবেশী যদি বিধর্মী হয়, তাকেও কুরবানির গোশত দিতে পারবেন।
তবে বেশিরভাগ ওলামায়ে কেরাম কুরবানির গোশতকে তিনভাগে বণ্টন করতে পরামর্শ দেন-
১। গরিব-দুঃখীদের জন্য২। নিজের আত্মীয় স্বজনের জন্য৩। নিজের জন্য
আমরা প্রথম দুটি ভুলে গিয়ে, তিন নম্বরটি নিয়েই বেশি মগ্ন থাকি।
হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকে এমন নিয়্যতে কুরবানি করার তৌফিক দান করুন, যেটা আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য। লোক দেখানো ইবাদত থেকে হিফাজত করুন।
আমীন!

লেখা ও গবেষণা
ওয়াদুদ খান 
প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ
সদরপুর সরকারি কলেজ, ফরিদপুর

তথ্যসূত্র
কুরআন ও হাদিসের দলীলসমুহ ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

Thursday, 16 August 2018

বড়ো ভয়ে বেঁচে আছি | ওয়াদুদ খান

বড়ো ভয়ে বেঁচে আছি


বড়ো ভয়ে বেঁচে আছি

ইদানীং প্রকাশ্যে কাশতে ভয় পাই 
ভয় পাই হাসতেও 
কি হাসিতে, কি কাশিতে 
বিপদের আনাগোনা দেখি
বড়ো ভয়ে বেঁচে আছি। 

জনাকীর্ণ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে 
জোরে কথা বলতে পারি না 
পারি না সবেগে মুতে দিতেও 
কি কথায়, কি মোতায় 
বিপদের আনাগোনা দেখি
বড়ো ভয়ে বেঁচে আছি। 

তোমাদের নষ্ট নগরে প্রকাশ্যে 
গলা ছেড়ে গান গাইতে পারি না 
পারি না বিড়িতে সুখটান দিতেও 
কি গানে, কি টানে 
বিপদের আনাগোনা দেখি
বড়ো ভয়ে বেঁচে আছি। 

দুঃসময়ের কবলে পড়া এই আমি- 
স্বাধীনচেতা কবি হতে পারি না
পারি না ফেসবুকে 
খিলখিল করে হাসা ছবি দিতেও 
কি কবিতে, কি ছবিতে 
বিপদের আনাগোনা দেখি
বড়ো ভয়ে বেঁচে আছি। 

১৬ আগস্ট, ২০১৮
সদরপুর, ফরিদপুর

Sunday, 29 July 2018

মোবাইলে প্রতারণা থামছেই না | পড়ুন, জানুন ও শেয়ার করুন


ঘটনা-১
তার নাম রশিদ। 'ভ্যান রশিদ' নামেই সে বেশি পরিচিত। দিন এনে দিন খান। হঠাৎ একদিন ফোন পেলেন। ওপাশ থেকে বলা হলো, "আপনি ১ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার জিতেছেন। কিন্তু এই টাকা উত্তোলনের জন্য কুড়ি হাজার টাকা বিকাশ করতে হবে।" কারও সাথে পরামর্শ না করেই ঋণ করে পরিশোধ করলেন কুড়ি হাজার টাকা। এরপর থেকে সেই ফোন নাম্বারটি সুইচ অফ। বেচারা রশিদ অজ্ঞতা ও লোভের মাশুল এখনো দিয়ে যাচ্ছে।

ঘটনা-২   
তিনি মসজিদের ইমাম। পাশাপাশি ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা করেন। হঠাৎ ফোন আসে, "আপনি কি ফ্রি রকেট একাউন্ট খুলতে চান? তাহলে ডায়াল করুন স্টার ওয়ান টু ওয়ান স্টার জিরো ফোর...... ইত্যাদি ইত্যাদি তারপর হ্যাশ বাটনে চাপুন।" হ্যাশ বাটনে চাপ দেওয়ার পর সেই ইমাম সাহেব খেয়াল করলেন তার মোবাইল থেকে ফ্লেক্সিলোডের চার নয়শত ছেচল্লিশ টাকা নেই। বলা বাহুল্য চার ডিজিটের পিন কোড দেওয়ার কথা বলে মূলত ওই টাকা হাতিয়ে নেয়। অর্থাৎ, "ফোর নাই ফোর সিক্স" আপনার নতুন কোড যা মূলত ওই টাকার এমাউন্ট।


ঘটনা-৩ 
"হ্যালো, আপনার সিমে নতুন একটা অফার এসেছে। ৫০০০/- টাকার টক টাইম ও কুড়ি জিবি ফোর জি ইন্টারনেট প্যাকেজ পাবেন দুই মাসের জন্য। এজন্য আপনার মোবাইলে ১০০০/- টাকা রিচার্জ করতে হবে আমাদের নির্দেশনা অনুসারে।" স্মার্ট ছেলে ইমরান ভাবলো, "টাকাটা যেহেতু আমার মোবাইলেই রিচার্জ করতে হবে, তবে রিস্ক নিতে আর সমস্যা কোথায়? তবুও পরীক্ষামূলকভাবে ও ১০০/- টাকার একটি কার্ড ওদের নির্দেশনা অনুসারে নিজের মোবাইলে রিচার্জ করতে গিয়ে, টাকা ওর নাম্বারে ঢুকেনি। ঢুকেছে ওদের নাম্বারে। ১০০/- টাকা লস দিয়ে সেই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিল ইমরান।

এমন ঘটনা আমাদের চারপাশে অহরহ ঘটছে। আমরা নিজেরা সতর্ক থাকি। অন্যদের সতর্ক করে দিই। অফার সংক্রান্ত কোনো ফোনকলে বিভ্রান্ত না হই। ঝোঁকের বশে রিকোয়েস্টিং বাটনে প্রেস না করি।

একান্ত প্রয়োজন হলে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিয়ে কথা বলতে পারি। মনে রাখবেন, ওরা কিন্তু সংঘবদ্ধ চক্র।

(বাকিটুকু শুনুন অডিওতে। ক্লিক করুন নিচের ইমেজে।)


দেখা থেকে লেখা 
ওয়াদুদ খান 
২৮ জুলাই, ২০১৮   

Wednesday, 25 July 2018

দুটি রম্য কবিতা /// ওয়াদুদ খান



(হাজারো বালক/ বালিকার মনের কথা ছন্দে ছন্দে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম)
১. হে বালক

হয়ে অলি          কেন এলি
আমার ছোট্ট জীবনে?
সব লুটে          এখন ছুটে
পালালি কার কাননে?

মিথ্যে বলে          হৃদয় নিলে
ছলে বলে তুমি।
ভালোবেসে          গেলাম ভেসে
চোখের জলে আমি।

রাত্রি জেগে          প্রেমাবেগে
লিখতে চিঠি কত
এখন দেখি          সবই ফাঁকি
তোমার কথা যত।

কিসের তরে          গেলে ওড়ে
আমার আকাশ ছেড়ে?
কোথায় গেলে          আমায় ফেলে
একলা রেখে ওরে?

আমি এখন          আছি কেমন
সেটা কি আর বুঝবে?
হারিয়ে গেলে          আঁধার কোলে
তখন আমায় খুঁজবে।

ওহে বালক          মনের চালক
তুমি আমার হলে না।
জনম ভরে          খুঁজে ফিরে
আমাকে আর পাবে না।

কবিতা লেখার তারিখ: ২০ আগস্ট, ২০১৬ (সন্ধ্যা)
বি.দ্র. যারা ছন্দোবদ্ধ কবিতা লেখার চর্চা করছো তাদের জন্য এই কবিতায় ভাবনার খোরাক আছে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।


২. প্রিয়তমা, করো ক্ষমা
করো ক্ষমা,          প্রিয়তমা
বাসবো না ভালো আর
ভালোবেসে          গেছি ফেঁসে
লাইফটা ছারখার।

কত বাঁশ,          কত ক্রাশ
খেয়ে যাব বলো না? 
মোর কথা,           শত ব্যথা
তোমরা তো বুঝলে না।

প্রিয়তমা,          করো ক্ষমা
'ভালোবাসি' বলবো না
ভুল মতে          প্রেম-পথে
আমি আর হাঁটবো না।

আমি একা          কত ছ্যাঁকা
খেতে পারি বলো আর? 
প্রেম ফেলে          যাব চলে
ফিরবো না কভু আর।

করো ক্ষমা,          প্রিয়তমা
প্রেম-ট্রেম আর না
খাব গাঁজা,          হব রাজা
প্রেম-ট্রেম তবু না।

২২ জুলাই, ২০১৮

Sunday, 22 April 2018

ফেসবুকের উদার নীল জমিনে ||| কবিতা

ফেসবুক কার কী উপকার করেছে?
জানি না। 
তবে, আমার করেছে সর্বনাশ।
আগে যেখানে চালাতাম 
কাগজের বুকে কলমের ফলা, 
এখন সেখানে চালাই
মোবাইলের বুকে
ক্লান্ত আঙুল।

সোনালি সকাল, 
রোদেলা দুপুর, 
উদাসী বিকেল, 
নিস্তব্ধ রাত, 
হাজারও জনতার মাঝেও গাঢ় নির্জনতায়  
সারাক্ষণ চোখ পড়ে থাকে 
ফেসবুকের  নীল খাতার পাতায়।

সন্ধ্যার সেই ঝাঁঝাল আড্ডা 
চলে গেছে কমেন্ট বক্সের দখলে।
কতদিন হয়ে গেল 
নীলাকাশ দেখি না।
ছুঁয়েও দেখি না- 
গল্প-কবিতার বই। 
জীবন আজ আবদ্ধ 
ফেসবুকের চার দেয়ালে।
রিয়েল লাইফে কী ঘটছে? 
জানি না আমি। 
আমার ভার্চুয়াল লাইফে
শুধু লাইক আর কমেন্টের খেলা।

আহ! ফেসবুক, 
তুমি না থাকলে,
আমার এই ভয়াবহ সর্বনাশের কথাই বা 
সবাইকে কীভাবে জানাতাম?

তাই,
বারবার হাটি ঘোরের সাথে
একই পথে ....
শুয়ে থাকি-  
ফেসবুকের উদার নীল জমিনে ....
আমার ঘুম আসে না। 
আসে কমেন্ট, শেয়ার, লাইক, রিয়্যাক্ট, 
ওয়াও, হা-হা-হা..... 

ওয়াদুদ খান
প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ 

বয়সটা ছুঁয়ে গেল পঞ্চাশ ||| রম্য কবিতা

দাড়িগুলো পেকে শেষ 
উঠে গেল সব কেশ 
বয়সটা ছুঁয়ে গেল পঞ্চাশ।




দাড়ি-গোঁফ পেকে সাদা 
বাচ্চারা ডাকে দাদা 
উঠে গেল চাপা থেকে দুই দাঁত।

রস-কষ ঠিকই আছে 
লাফ দিয়ে উঠি গাছে 
তারুণ্যে ভরে আছে মন-প্রাণ।

বয়সটা পায়ে ঠেলে
যুবাদের আছি দলে
মানি না, মানবো না বয়সের কাছে হার।

ওয়াদুদ খান
২০ মার্চ, ২০১৮

Monday, 16 April 2018

নাই নাই নাই (দুটি বৈশাখী রম্য কবিতা)



এক.

বৈশাখী মেলা আছে,
বৈশাখী খেলা নাই।
মেলায় গিয়ে ঠেলা খেলে
তাতে মনে জ্বালা নাই।

পুলিশের তুলনায় আজ দেশে ইলিশ নাই।
বসন্ত আছে তবে সেই
কোকিল নাই।
হামলা হলেও মামলা নাই,
মামলা হলেও ভালো উকিল নাই।

গরীবের যতো দোষ,
ধনীদের দোষ নাই।
ঘুষ খাবার বেলায়
ওদের কোনো হুশ নাই। 
সুদের তুলনায় আজ দেশে
গরুর দুধ নাই।

প্রচুর নেতা আছে,
নেতার কোনো নীতি নাই।
মানুষে মানুষে কোনো প্রীতি নাই। 
দেশে পরীক্ষা আছে,
তবে পড়াশোনার গোষ্ঠী নাই।
যতো প্রশ্ন ফাঁস আছে,
দেশে ততো হাঁস নাই।

মেধা আছে, তবে কোটা নাই
কোটার খোটা ছাড়া আর চাকরি নাই।
যার আজ খালু নাই, মামু নাই
চাকরির বাজারে তার
আম-ছালা নাই।
পাছায় আজ বাঁশ আছে,
গলায় কোনো মালা নাই।

দুই. 

পকেট আছে টাকা নাই
সবার মন আছে,
তবে কারো মন আজ ফাকা নাই।
গরম আছে তবে শরম নাই।

শোক আছে, মনে সুখ নাই
প্রেম ভাংগে তাতে দুখ নাই।
নষ্ট হই তাতে কষ্ট নাই।
বাজারে লেবু আছে,
তাতে একফোঁটা রস নাই।
গরীবের কাম আছে তবে
কামের দাম নাই।
আলুর তুলনায় আজ বালু নাই।

সাধ আছ কিন্তু সাধ্য নাই। 
গরীবের চিত্ত আছে কিন্তু বিত্ত নাই।

প্রেম আজ মুখে বলে,
কিন্তু সেটা বুকে নাই।
সবাই খুব মুডে চলে,
আসলে কেউ সুখে নাই। 

ওয়াদুদ খান 
কবি ও কথাশিল্পী 

Sunday, 15 April 2018

কোটা: দাদা ও নাতির কাব্যিক কথামালা


"শুনছ নাকি ও দাদা গো, শুনছ নাকি খবর?
পোলাপানের দাবির চাপে কোটার হলো কবর!
তাই যদি হয় তুমিই বলো- ক্যামনে পাবো জব?
আমি গাধা নাই তো মেধা- ভালোই জানো সব। 
বাচ্চাগুলো দিবস-রাতি দিক না যতই খোটা
এই দেশেতে চাকরি পেতে লাগবেই আমার কোটা। 
কোটা ছাড়া যায় কি পাড়া- দাঁড়িয়ে-বসে আম?
গাছের তলায় শূন্য হাতে ঝরবে পিঠের ঘাম! 
ও দাদা গো চুপ আছ ক্যান? কিছু একটা করো- 
কোটার জন্য লাগলে আবার অস্ত্র হাতে লড়ো। 
কোটা যদি না থেকে মোর চাকরি ক্যামনে হবে?
তোমার নাতি হয়ে আমার লাভটা কী আর তবে?"

মুখ খুলে কয় দাদা এবার, "শোনো আমার নাতি, 
মেধা ছাড়া কোনো গাধার থাকবে না আর গতি।
যুদ্ধে গেছি দেশের তরে কোটার জন্য নয় রে 
দেশ পেয়েছি সব পেয়েছি এতেই মোদের জয় রে! 
পড়াশোনা করলে বেশি চাকরি ঠিকই আছে 
মেধাশূন্য বাচ্চাগুলো ঘুরছে কোটার পিছে। 
কোটা গেছে বেশ হয়েছে মজায় আছি এখন- 
এবার ঠিকই হবে পূরণ জাতির পিতার ভিশন!" 

কবি ও কথাশিল্পী 

Monday, 9 April 2018

কোটা বিরোধী যোদ্ধা (মর্মস্পর্শী ছোটোগল্প)


দিন শেষে বিকেলটা বড়ো অপূর্ব লাগে। হয়তো জীবন সায়াহ্নটাও লাগে তেমনি আকর্ষ জাগানিয়া। সুন্দর বিকেলটা খুব দ্রুতই হারিয়ে যায় রাতের নিঃসীম গাঢ় অন্ধকারে। এই অদ্ভুত জীবনটাও তেমনি খুব দ্রুতই হারিয়ে যায় মরণ নামের এক অন্ধকার বলয়ে। ষাট বছর বেঁচে থাকা আসলেই বড়ো কম বেঁচে থাকা। 

হুমায়ূন আহমেদের একটা কথা মনটাকে মাঝে মাঝেই ভীষণ আলোড়িত করে- "একটা কচ্ছপ যেখানে অবলীলাক্রমে বেঁচে থাকে কয়েক শো বছর, সেখানে মানুষ নামের এই বিচিত্র প্রাণিটা কেন মরণের নিকষ কালোয় হারিয়ে যাবে ষাট কিংবা সত্তর বছর বয়সে? একটাই জীবন। অথচ, কতো ছোট্ট তার ব্যাপ্তি। 
তবুও তো কম বেঁচে থাকলাম না আমি।
মৃত্যুর সাথে নিরন্তর বসবাস করে আসা এই আমি দেখলাম- প্রায় ষাটটি বসন্ত।
ভাবা যায়?

যে দেশে মানুষ মরে গরুর চেয়েও অবহেলায়। সেই দেশে এতোটা বছর বেঁচে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। হঠাৎ মরণ নিয়ে এতো ভাবছি কারণে যে, আমি আমার মরণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি গতকাল গভীর রাতে।
প্রায় দুইমাস ধরে জন্ডিসে ভুগছিলাম। গ্রামের মুরুব্বিদের কথা শুনে প্রথমে কিছুদিন কবিরাজি চিকিৎসা করলাম। পানি পড়া, দই পড়া খেলাম। এমনকি গলায় ঝুলিয়ে দিলাম তাবিজ। না, কিছুতেই কিছু হলো না। সবার এক কথা- জন্ডিসের কোনো চিকিৎসা নেই। জাস্ট কমপ্লিট রেস্ট। লাগাতার ‍শুয়ে থাকা।  নানান প্রকারের শরবত আর ডাবের পানি খাওয়া। 
হলুদ রঙের সবকিছু খাওয়া নিষিদ্ধ।

কিছুদিন হোমিওপ্যাথিও চেষ্টা করে দেখলাম। কোনো উন্নতির লেশমাত্র নেই। যে যা বললো তাই করলাম। এমনকি একজন কবিরাজের কথামতো পুকুরে টানা দশদিন ডুব দিলাম খুব ভোরে। পাকা কলার ভেতরে জোনাকী পোকাও ভরে খেলাম তিন রাত্রি। আমার মতো কতো জন্ডিস রোগী এরকম অপচিকিৎসার শিকার হয়ে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে তার হিসেব কেউ জানে না। কোনো গতি না দেখে আবার এলোপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করলাম। 

অবশেষে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গেলো- আমাকে আক্রমণ করেছে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। দেখলাম পেটটা ক্রমাগত ফুলে উঠছে এবং লিভারে প্রচন্ড ব্যথা। শেষমেষ ঢাকা যাই। ঢাকা থেকে মাদ্রাজ। মাদ্রাজ থেকে আবার ঢাকা। ঢাকা থেকে শেষবারের মতো আবার ফিরে আসি গ্রামের বাড়িতে।  ফিরে আসা সুস্থ হয়ে ফিরে আসা নয়।  ফিরে আসা চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুর কাছে ফিরে আসা। নিরুপায় আত্ম সমর্পণ।  ফিরে আসাটা অচেনা, অজানা, অদেখা এক নতুন জগতে ফিরে যাবার জন্য। 

আমি যে মরে যাবো- একথা কেউ আমাকে বুঝতে দিতে চাচ্ছে না। সবাই বলছে মরা গাছে পাতা ধরবার মতো নতুন করে আবার সজীব হয়ে উঠবো আমি।

গতকাল গভীর রাতে অতি সন্তপর্ণে আলমারি থেকে আমার যাবতীয় রিপোর্ট বের করি রিপোর্টে যা দেখি তাতে হাসি পায় আমার। আমার লিভার সিরোসিস হয়েছে।সম্ভাব্য মৃত্যুর তারিখ ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭। 
একথা জানবার পরেই দেখলাম এই জঘন্য পৃথিবীটা বড়ো অপূর্ব লাগছে আমার কাছে।

মরে যাবো বলেই হয়তো নদীর ঘোলা জল, ইঁদুরের উৎপাত, কাকের কুৎসিত কা-কা শব্দ, এমনকি মাছির ভনভন গান- এক আশ্চর্য সুর হয়ে কানে বাজছে। যে জীবনটাকে মনে হতো বঞ্চনার, প্রতারণার, হতাশার, কষ্টের- আজ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনটাকে মনে হচ্ছে মধুময়। ইচ্ছে করে বেঁচে থাকি। বেঁচে থেকে দেখে যাই.........

কী দেখে যাবো?
কীইবা দেখবার বাকি আছে আমার? কম তো দেখলাম না।
কী পেয়েছি জীবনে?
বলবার মতো, মনে রাখবার মতো কিছুই কি পেয়েছি?
কেন জানি আজ জীবন নাট্যের শেষ অঙ্কে এসে কোনো হিসেব মেলাতে পারছি না। দুয়ে দুয়ে চার হলো না আমার জীবনে।

মরণের সাথেই যার বসবাস ছিলো একদা। অথচ, আজ সে মরণ দেখে ভীষণ ভীতু। বাঁচার নেশায় আজ সে দিশেহারা।  
স্মৃতির নদীতে সাঁতরাতে থাকি। চলে যাই ৪৬টি বছর আগে। সেই একাত্তরে। তখন এক টগবগে তরুণ আমি।বয়স আঠারোর বেশি হবে না। অনেক কিছু বুঝি। আবার অনেক কিছু বুঝিও না। তবে এতোটুকু খুব ভালো করেই বুঝতাম-
ওরা আমার মায়ের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।
তাই, একটি ফুলকে বাঁচাবার জন্যে, একটি নতুন কবিতা লেখার জন্যে- নাম না জানা হাজারো যুবকের মতো আমি আর বিপ্লব যুদ্ধে যাই। 
কী ভয়ংকর দিনই না ছিলো!

দাড়িয়াপুর পাহাড় সীমান্তে যুদ্ধ চলছিলো। সম্মুখ সমর। কান ফাটানো গুলির শব্দ। ভয়ার্ত আর্তনাদ। রক্তের হোলিখেলা। হাহাকার। চিৎকার। আমরা তখন অকুতোভয় সৈনিক। যুদ্ধ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পিছু হটে গেছে হায়েনার দল। আমরা ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময় দেখলাম- বিপ্লব একটা শব্দ করলো- আহ!
তারপর দেখলাম- ওর ঘাড়ের পেছনে গোল একটা গর্ত।
লুটিয়ে পড়লো বিপ্লব।
মুছে গেলো একটি নাম।
কতো সহজ ছিলো মৃত্যু। 
সেইসব দিনে। 

তারপর অনেক ভেবেছি- ঠিক ওইরকম আরেকটা গুলি বুকে লেগে যেতে পারতো আমার। আমিও মারা যেতে পারতাম বিপ্লবের মতো।
মারা গেলে হয়তো ভালোই হতো। এক অন্তহীন আশা নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে মরতে পারতাম আমি। অথচ, বিপ্লবের চেয়ে ৪৬টি বছর বেশি বেঁচে থেকে, ৪৬টি শীত, বসন্ত, বর্ষা বেশি দেখে কী লাভ হলো আমার?
আশা ফুরালো।
স্বপ্ন হারালো।
জীবনটা আবদ্ধ আজ নিরাশার বলয়ে।

স্বাধীনতার ৪৬টি বছর পরে এসে মনে হচ্ছে এই দেশটা চাইনি আমি। এই দেশের জন্যে সেদিন যুদ্ধে যাইনি আমি। আমরা। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় আজ আমি মুহ্যমান। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা আজ বড়ো কোনঠাসা। মুক্তিযোদ্ধা শব্দটা চলে গেছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে।

আমাদের গ্রামের খয়ের মুন্সি ছিলো নামকরা রাজাকার যুদ্ধের সময় অসংখ্য হিন্দু যুবতী মেয়েকে তুলে দিয়েছিলো পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে। এক গাল দাড়ি আর তসবি হাতে বলেছিলো, "ওরা হচ্ছে গনীমতের মাল। যুদ্ধের সময় সবই জায়েজ।"

এই বিশিষ্ট রাজাকার আজ 'খয়ের মুন্সি' থেকে হয়েছে 'বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা খয়ের উদ্দীন'
বীর মুক্তিযোদ্ধা খয়ের উদ্দীন কিছুদিন আগে গ্রামের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে।
ভাবা যায়?

একদিন আমার কাছে এসে বললো, কী খবর ভাই? ভালো আছেন?
আমি বললাম, হুম।
খয়ের রাজাকার একটা কুৎসিত হাসি দিয়ে বলতে থাকে- মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হচ্ছে। মাসে মাসে ভাতা দিবে। নামটা তালিকায় ওঠালাম। কমান্ডার ফজলুল হককে সাত হাজার টাকা দিতে হলো। দশ হাজার টাকা চাইছিলো। অনুরোধ করাতে তিন হাজার টাকা কম নিলো। আপনার নাম তো তালিকায় দেখলাম না। তাড়াতাড়ি নাম ওঠান। শুনলাম ভাতা-টাতা পাওয়া যাবে। চাকরিতে কোটাও নাকি দিবে।

এক অন্তহীন ঘৃণায় মুখটা বিকৃ হয়ে গেলো আমার। 
এই জন্যে সেদিন যুদ্ধে গিয়েছিলাম?
এই জন্যে?
এইসব রাজাকারের বাচ্চাদের মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধা দেবার জন্যে?
এইসব দেখবার জন্যে বেঁচে আছি এতোটা কাল?
এই মূল্য পেলো আমার বন্ধু বিপ্লবের তরতাজা একটা প্রাণ?   

 যে দেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ঘুষ খেয়ে চিহ্নিত খয়ের রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধা বানাতে পারে, সে দেশে আর কারো কাছে নীতি শব্দটাকে আশা করা বোধ হয় ঠিক না। ঘৃণার অনলে পুড়ে যাওয়া এই আমি- তাই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখাতে যাই না। 
কোনো ভাতা-টাতা পাবার আশায় তো সেদিন যুদ্ধ করিনি। যুদ্ধ করিনি কোনো কোটা খোটার জন্যেও। 

খয়ের রাজাকার মুক্তিযোদ্ধার হাসি হাসে। 
আর আমি মুক্তিযোদ্ধা থেকে হয়ে যাই একজন সাধারণ নাগরিক। 
আর আমার বন্ধু বিপ্লব হারিয়ে যায় আরো দূরে..........

এইতো কদিন আগে খয়ের রাজাকারের সাথে দেখা। তখনো আমার জন্ডিস হয়নি। রাজাকারটা আমাকে বললো, ‍"আপনাকে বললাম মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটটা নিতে। নিলেন না। এখন বুঝেন মজা! আপনার ছেলে রাশেদের এবারো বিসিএসটা হলো না। অথচ, আমার ছেলে কামাল এই বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রশাসন ক্যাডার পেয়ে গেলো।"

আমার ছেলে রাশেদ ভীষণ মেধাবী। কিন্তু ইদানীং সে ভীষণ হতাশাগ্রস্ত। পরপর তিনবার বিসিএসে ভাইভা দিয়েও কোনো ক্যাডার পেলো না সে। একদিন বাসায় ফিরে রাগ করে আমাকে বললো, "আমি আর বিসিএস টিসিএস দিতে পারবো না। সব চলে গেছে কোটা আর খোটার দখলে। পরে ওর লেখা একটা কবিতা আমাকে পড়ে শোনালো- 

এই দ্যাশ
এক্কেবারে শ্যাষ। 
মেধাবীরা ডুবছে কাদায়
চাকরি হচ্ছে কোটায় আর খোটায়। 
চাকরির বাজার আজ মামা আর চাচার দখলে
আসলের জায়গা নিছে নকলে। 
পরীক্ষা দিলেই এখন পাশ
অনেক আগেই হয় প্রশ্নপত্র ফাঁস। 
রাজাকাররা কার চালায়
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা শুধু গাল হাতায়। 
যাচ্ছে বাঁশ আজ দেশের পাছায়
তবুও বাঙালি বেঁচে থাকে মিথ্যে আশায়..."

কবিতটা শুনে খুব কান্না পেলো আমার। দরজা বন্ধ করে কতোক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। কী এক অন্তহীন ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, হতাশা নিয়ে আমার ছেলেটা দিন কাটাচ্ছে। কবিতার ভাষা অনেকের কাছেই নোংরা মনে হতে পারে। কিন্তু এই বর্তমান পরিস্থিতিই ওকে বাধ্য করেছে এসব লিখতে। আমি একজন বাবা। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। পরাজিত যোদ্ধা। লজ্জায় ওর সামনে ইদানীং দাঁড়াতেই পারি না। অপার সম্ভাবনাময় একটা ছেলে পানি না পাওয়া গাছের চারার মতো শুকিয়ে যাচ্ছে। মারা যাচ্ছে। একথা ভাবতে ভালোলাগে কোনো বাবার? এই তো সেদিন ওর মা আমাকে বললো, "জানো- রাশেদ তো চাকরির ধান্দা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দিয়েছে সব ধরণের জব স্টাডিও।" 

সেদিন ওর ডায়েরিটা হাতে নিই আমি। দেখি তাতে কোনো আশাবাদের কথা লেখা নেই। লেখা আছে হতাশার কথা। চরম ঘৃণার কথা। একটা পাতায় লেখা রয়েছে-
"ইদানিং ইচ্ছে করে বিসিএস ক্যাডার নই, হয়ে যাই সন্ত্রাসী ক্যাডার। কারণ, সন্ত্রাসীরাই সব ক্যাডারের বাপ। ইচ্ছে করে খুন, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কিডন্যাপ ইত্যাদিকে নিই ক্যারিয়ার হিসেবে। সাফল্যের আকাশে ওঠার সিঁড়ি আজ নীতি নয়। দুর্নীতি। যারা দুর্নীতিবাজ, চোর, বদমাশ- সম্মান আজ তাদেরই বেশি। তাই মাঝে মাঝে মন চায়- কলমটা হাত থেকে ফেলে দিই। হাতে তুলে নিই অস্ত্র। নষ্ট হলে ইদানীং কেষ্ট মিলে। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে না আর।"   

পড়ি আর দেখি আমার মনটা সুতোর মতো ছিড়ে যাচ্ছে। 
শত টুকরো হয়ে যাওয়া মন নিয়ে ভালো কিছু ভাবার, ভালো কোনো স্বপ্ন দেখার শক্তি হারিয়ে ফেলি আমি। আজ এই নিষ্ঠুর বর্তমানের সামনে দাঁড়িয়ে সেই ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বড়ো বেশি অকারণ মনে হয়। প্রশ্ন জাগে, এভাবে ত্রিশ লক্ষ লোকের শহীদ হওয়া এবং দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর কোনো মানে ছিলো কি? 

আজও মন্দির ভাঙে। 
পতাকাটা আজও খাবলে খায় সেই পুরনো শকুন। 
গুড়িয়ে দেয় শহিদমিনার। 
আজো সুধাংশুরা চলে যায় এদেশ ছেড়ে। 
সিঁথির সিঁদুর মুছে যায় হরিদাসিদের... 

রাশেদের ডায়েরীর পাতা উলটাতে থাকি। 
আর দেখি অন্তহীন ক্ষোভ ঝরে পড়েছে প্রতিটা পাতায় পাতায়। 
এক জায়গায় লেখা-

"রাজাকাররা আজ ফুলে কলাগাছ,
খায় ওরা রুই কাতলা মাছ,
হরতালে অবরোধে ওরা কাটে গাছ
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে 
কোটায় নিচ্ছে জব 
ভাতা-টাতা সব।  

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পেট ঠেকেছে পিঠের সাথে
জোটে না নুন তাঁদের পান্তা ভাতে। 
ইচ্ছে করে তাই-
আগুন ধরাই
পুড়াই, সব পুড়াই... 

তারপর খাই গুলি
উড়ে যায় যাক না আমার মাথার খুলি। 
হয়ে যাই লাশ
আমার লাশ হোক এক নয়া ইতিহাস...

আমার লাশের মূল্যে দূর হোক 
যত কোটা-খোটা বৈষম্য 
সুযোগের সমতাই হোক নতুন দেশের ধর্ম..."  

আবোল তাবোল ছন্দে লেখা কবিতাগুলোই আমার কাছে পায় এক অনন্য সাহিত্যের মর্যাদা। এভাবে একটা উদীয়মান সূর্য অন্ধকার মেঘের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে দেখে মনটা কেমন জানি ফাঁকা হয়ে আসে। 

যে ছেলেটা এখন বিসিএস ক্যাডার হয়ে নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখার কথা, সেই ছেলেটা এখন কী সব কবিতা লিখছে? ওর মতো বয়সী একটা ছেলে লিখবে প্রেমের কবিতা। ওর কাছে মনে হবে আকাশটা গাঢ় নীল। ঘাস আর গাছগুলো ওর কাছে মনে হবে গাঢ় সবুজ। পাখিদের মনে হবে একটু বেশিই নীড়মুখী। অথচ, এক নীড়হারা পাখির মতো ফালতু একটা আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে রাশেদ। 
একটা স্বপ্নহীন জগতে ওর সারাক্ষণ বসবাস। 
আহ! মাথাটা ধরে আসে আমার। 

কয়েকটা দিন পরেই মরে যাবো আমি। জানি না- ২০১৮ সাল দেখে যেতে পারবো কিনা। কীইবা হবে নতুন একটা সাল দেখে?
যেখানে গত ৪৬টি বছরেও আমাদের পেটের মুক্তি মেলেনি, মেলেনি মনের মুক্তিও, সেখানে আগামী দিনে কী যে মিলবে তা সহজেই অনুমেয়। 

পুরো পৃথিবীটা কেমন জানি ধূসর মনে হয়। মনে হয়, চারপাশ নিকষ কালো। গভীর অন্ধকার। সব কিছু মনে হয় অর্থহীন। 
অর্থহীন মনে হয়, এতোটা বছর বেঁচে থাকা। আবার মরে যাওয়াও। 

গভীর মর্মবেদনা নিয়ে বাইরে বের হই... 
দেখি উপরে বিশাল আকাশ। গাঢ় নীল। দূরে একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে। বাড়ির পাশেই একটা নদী। তাতে ঘোলা জল। 
কেন জানি জীবনের শেষ কিনারে দাঁড়িয়ে এই নদীর ঘোলা জল, উপরের গাঢ় নীলাকাশ, পাখির কিচিরমিচির- সবকিছুর প্রতিই সুতীব্র টান অনুভব করছি। বাঁচতে ইচ্ছে করছে পাগলের মতো।

"একটা গোলাপফুল কীভাবে ফোটে? আবার সেই ফুটন্ত গোলাপ  কীভাবে ঝরে যায়?"-এই দুঃসহ দৃশ্য দেখার জন্য অন্তত বেঁচে থাকতে চাই না।  

হতাশার মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে সীমানার ওপারে যাবার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি..............

লেখার তারিখ: ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৭

লেখা: ওয়াদুদ খান