Tuesday, 29 August 2017

নই তো কবি

নই তো লেখক, তাই বলে কি
মনের কথা লিখবো না?
আমার মনের দহন ব্যথা
ইচ্ছে মতো আঁকবো না?


নই তো কবি, তাই বলে কি
আসবে না মোর ছন্দ?
সরবে না কি তৈরি হওয়া
মনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব?

নই তো ধনী, তাই বলে কি
স্বপ্ন আমার থাকবে না?
জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি
পাবো কেবল সান্ত্বনা?

আতেল আমি, তবুও লিখি
বেতাল মনের কবিতা।
নিজের সাধে নিজেই উড়ি
ভাবুক লোকে যা খুশি তা।

ওয়াদুদ খান 
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
সদরপুর, ফরিদপুর।

অকারণ মরণ (এক মেধাবী ছাত্রের ঝরে যাওয়ার কাহিনি)

আছি
মৃত্যুর কাছাকাছি
যাবো চলে
সব ফেলে
ঐ দূর পরপারে
কেউ কি খুঁজবে আমায়
রাতের অন্ধকারে? 

এখান থেকে শুরু


পর্ব-১


অবশেষে মরণ হলো আমার।
পৃথিবীতে কেউ অমর নয়। তাই, আমি যে মরলাম- এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এইভাবে এত তাড়াতাড়ি মরতে চাইনি আমি।

আমি যখন পৃথিবীতে আসি তখন কেউ খুশি হয়েছিল এমনটা শুনিনি। বরং রাগে, অভিমানে সেদিন বাবা নাকি বাড়িতেই আসেনি। কারণ, আমাদের ঐ নিম্নবিত্ত পরিবারে আমার আগে আরও চারজন জায়গা করে নিয়েছিল। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’- এমন সংসারে আমার জন্মগ্রহনটা শুধু সংখা বৃদ্ধিই ঘটিয়েছিল।

যার আগমনে যেখানে এই পৃথিবীর কারও কোনো আনন্দ নেই, তার চির প্রস্থানে পৃথিবীর  কারও এতটুকু দুঃখ থাকবে না- সেটা খুব ভালো করেই জানতাম আমি। বাঁচার নেশা ছিল আমার মদের নেশার চাইতেও বেশি।

প্রায়ই ভাবতাম -
কী হবে মরে গিয়ে?
কে ছাড়বে দু’ফোটা জল আমার জন্যে?
কে ছাড়বে একটু দীর্ঘশ্বাস?
যার বেঁচে থাকায় এই পৃথিবীর কিছু যায় না, আসে না। তার মরণেও এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর কিছু যাবে না, আসবে না- এটাইতো স্বাভাবিক।

কী ফালতু জীবন আমার!
বেঁচে থাকায় কোনো আনন্দ নেই।
মরণেও যেন এতটুকু স্বান্ত্বনা নেই।
বহতা নদীর মতো অকারণ ছুটে চলা।
আর সাগরের অন্তহীন জলরাশির সাথে মিশে নিজেকে হারিয়ে ফেলা।

তবুও- জীবনটা কেন জানি মনে হতো ভীষণ সুন্দর। রোমাঞ্চকর। তাই, মরে গিয়ে- হেরে যেতে চাইনি আমি। হয়তো এই সুতীব্র বাঁচার নেশাটাই- মৃত্যুকে আকর্ষণ করেছিল বেশি।

আমি সুকান্ত নই। নই শেলী, কীটস কিংবা বায়রন। বয়স তাই তেইশ পেরিয়ে গেলেও, এমন কিছু করতে পারিনি- যার জন্য মরণের পরেও কেউ মনে রাখবে আমায়।

ছোটোবেলা থেকেই কবিতা লেখার খুব নেশা ছিল আমার। ভেবেছিলাম- বড়োমাপের একজন কবি হবো আমি। কবিতাও লিখেছিলাম অনেকগুলো। একটি কবিতা আজও মনে পড়ে। তবে কবিতার নামটা মনে নেই।

আছি
মৃত্যুর কাছাকাছি
যাবো চলে
সব ফেলে
ঐ দূর পরপারে
কেউ কি খুঁজবে আমায়
রাতের অন্ধকারে?

মাগো তুমি হীনা

কেউ মনে রাখবে কিনা
জানি না।

আজ নয় কাল

হয়ে যাবো একদিন স্মৃতির আড়াল
সাগরের এক ফোঁটা পানির মতো
ফুরিয়ে যাবো
হারিয়ে যাবো
কেউ জানবে না।
কেউ জানবে না।

এমন ছাইপাশ আরও অজস্র কবিতা।
কিন্তু এক সন্ধ্যায়-
এক মেয়ের সাথে অভিমান করে সমস্ত কবিতা এক পুকুরে ফেলে দিয়েছিলাম। কবিতার খাতার মতো আমার ভিতরকার কবি মানুষটাও সেদিন পুকুরে ডুবে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।

তারপর আর কখনো চাঁদের দিকে তাকিয়ে কোনো মুখ দেখতে পাই নি আমি। মেঘের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাইনি কোনো ঘন কালো চুল। ফুলের দিকে তাকিয়ে মনে হয়নি- কারো মন ফুলের মতো সুন্দর।

তবুও জীবন এগিয়ে চলছিল। অর্থহীন এক পরিনামের দিকে। দেখতে দেখতে অনার্স তৃ্তীয় বর্ষে পা রাখলাম আমি।


পর্ব-২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম আমি। মরণ দেখে ভীষণ ভীতু এই আমি ঢাকা শহরের মূল রাস্তায় বের হতাম কম। হরতাল কিংবা হরতালের আগের দিন- সারাটাদিন রুমে বসে বই পড়তাম। কারণ, প্রতিটা হরতালে অনেক নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছিল।

সেদিনের সকালটা ছিল চমৎকার। রোদ্রকরোজ্জ্বল। মনটাও ছিল ফুরফুরে। পকেটে ছিল সদ্যপ্রাপ্ত টিউশন-ফির হাজার পাঁচেক টাকা। একটা রিকশা ভাড়া করে মতিঝিল যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কেন জানি ঢাকা শহরটা খুব সুন্দর লাগছিল। এই নোংরা শহরটাকে এত ভালো আগে কখনো লাগেনি তো!

মতিঝিল শাপলা চত্বরে নেমেই থমকে দাঁড়াই। একি শুরু হয়েছে এখানে! একদিকে জামাত শিবিরের জঙ্গী মিছিল ধেয়ে আসছে। তাদের সবার হাতে লাঠি আর ইটের টুকরো। অন্যদিকে তাকিয়ে দেখি শত শত পুলিশ।

আজ তো হরতাল নয়। তাহলে হঠাৎ কী শুরু হলো এখানে! দেখি শিবিরের লোকজন ‘নারায়ে তাকবীর- আল্লাহু আকবার’ বলে নির্বিচারে গাড়ি ভাঙছে। পোড়াচ্ছে। ছুড়ে মারছে ইটের টুকরো। আর পুলিশ বাহিনি ছুড়ছে কাঁদানে গ্যাস, জল কামান আর রাবার বুলেট। আমি ৭১ দেখিনি। দেখেছি ২০১৩। মনে হচ্ছিল আরেক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে এখানে।

অকারণ মরণ


আমি ঢাকা শহরের অলি গলি তেমন চিনি না। কোথায় পালাবো বুঝতে পারার আগেই দেখি- আমার কপালের এক কোণা বেয়ে রক্ত ঝরছে। দু’হাত দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। তখন আর একটা শব্দ এল কানে.........

দেখলাম- বুক বরাবর কি যেন একটা ঢুকে গেলো। হঠাৎই ঘোর লেগে গেল চোখে। দেখি- বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর আমার দু’চোখের সামনে- চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাওয়া আমার বাবার মুখখানা.........

তারপর যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম- ততক্ষনে মরণ হয়ে গেছে আমার। প্রায় আট ঘন্টা জীবনের সাথে যুদ্ধ করে গভীর রাতে হেরে যাই আমি। তবে মরে গিয়ে দেখলাম- আমি মানুষটা অতো কম দামী নই। পঁচিশ হাজার টাকার একটা চেক পেয়েছে আমার পরিবার। খারাপ কি আমার জীবনের দাম?

যে আমি এদেশের রাজনীতিকে ‘গু’ এর চাইতেও বেশি ঘৃ্না করতাম- মরণের পরে দেখলাম- সেই আমি নাকি শিবিরের একজন ত্যাগী কর্মী। আমি নাকি শহিদ হয়ে গেছি।

আবার দেখলাম- ছাত্রলীগ বলছে, "আমি নাকি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমি নাকি মুজিব সেনা।"
আমার বিধবা মায়ের সারা জীবনের কষ্ট। তার শখের সোনার হার বিক্রি করে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা। আর কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করে শেয়াল ডাকা রাত্তির পর্যন্ত- নিরন্তর ক্লাশ, টিউশন কিংবা  বই পড়ায় মগ্ন থাকা- সবই ব্যর্থ হয়ে গেল কয়েকটি ইটের টুকরো আর একটা বুলেটের কাছে। মুহূর্তেই।

একটা মোবাইল নাম্বার বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে। চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। এরকম বন্ধ হচ্ছে প্রতিদিন। তাই পৃথিবীর কিছু এল না। কিছু গেলও না।
ভেবেছিলাম- মরণের পর কারো মনের পাতায় কিংবা কারো লেখার খাতায় ঠাঁই হবে না আমার। অবাক হয়ে দেখলাম- পরের দিন বেশ কয়েকটি পত্রিকায় ছোটো করে হলেও জায়গা পেয়েছি আমি। কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম ছিল এমন-

(১) "শাহাদাত বরণ করলেন আরেক শিবির নেতা”- দৈনিক চার দিগন্ত
(২) “শিবিরের হামলায় প্রাণ গেল আরেক মুজিব সেনার”- দৈনিক মানুষকন্ঠ
(৩) “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র খুন”- দৈনিক ভোরের আলো

তারপরের দিন- খবরের পাতা ভরে গেল অন্যসব নতুন খবরে।
আর আমি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলাম মহাশূন্যে। ধোঁয়ার মতো...............

লেখা: ওয়াদুদ খান
কবি ও কথাশিল্পী

[লেখার প্রেক্ষাপট: ২০১৩ সালের (সমকালীন) রাজনীতি
লেখার তারিখ: ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৩]

ক্ষয় (করুণ প্রেম ও অবক্ষয়ের কাহিনি)



তোর মতো আমারও একটা মন ছিল। কিন্তু সেই মনের দরজায় মস্ত এক তালা ঝুলিয়েছিলাম। কেননা, কারও ভালোবাসা পাবার যোগ্য আমি ছিলাম না। এই যান্ত্রিক পৃথিবীতে ভালোবাসা পেতে কিংবা দিতে বুক বোঝাই ভালোবাসা নয়, লাগে পকেট বোঝাই টাকা। কিন্তু নিজের এই অক্ষমতা, অযোগ্যতা কিংবা দারিদ্রতা কারো কাছে প্রকাশ করতে চাইতাম না আমি। তাই কৌশলে শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। সেটাই বোধহয় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার জীবনে।

এখান থেকে শুরু

পর্ব-১

(এই গল্পটা যতবার পড়ি- ততবারই চোখ জলে ভিজে যায়। এটি একটি ট্রাজিক প্রেম ও অবক্ষয়ের কাহিনি)

আমি ইমরান।
আমার বন্ধু রাজিব। ও দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি চটপটে। ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হবার পর। আমাদের কলেজের বাংলা স্যার ছিলেন খুবই আমোদে। মাঝে মাঝেই ক্লাশে হাসির কবিতা আবৃত্তি করতেন উনি। ছাত্রছাত্রীদেরকেও উৎসাহিত করতেন কবিতা লিখতে। বাংলা স্যারের ক্লাশে রাজিব নিজের লেখা একটা কবিতা পড়ে শোনালো-

এই কলেজে পড়ি আমি
আমি পঁচা ছাত্র
লেখাপড়া করি না
বই কিনেছি মাত্র।

স্যাররা আমায় গাধা বলে
আমি তাতে খুশি
স্যাররা যখন গরু বলে
তখন তাদের দুষি।

বলি, ‘গাধা সে তো ভালোই বড়ো
বুদ্ধি আছে কিছু
গরু সে তো মূর্খ বড়ো
বুঝে না তো কিছু।
আমি স্যার বুঝি কিছু’,
শুনে স্যার হাসে।
বলে, ‘তুই বুঝস
ঘোড়ার ডিম জলে ভাসে।’

আমি বলি, ‘না, না স্যার,
ডিম পাড়ে না তো ঘোড়া।’
স্যার বলে, ‘বুঝস ভালোই
পারস না ক্যান পড়া?’

রাজিবের এই হাস্যরসে ভরা কবিতা শুনে ওকে ভীষণ ভালো লেগে যায় আমার। তারপর খুব কৌশলে ওর সাথে বন্ধুত্ব জমিয়ে ফেলি।

কিছু কিছু বন্ধু হয়- যাদের সাথে মিশে মানুষ নষ্ট হয়। আবার কিছু কিছু বন্ধু আছে যাদের সাথে মিশে ভালো হয়ে যায় অনেক ছেলে। রাজিব ছিল এমন একটা ছেলে যার প্রত্যেকটা দিকই ভালো লাগতো আমার। এবং ভালো হবার অনুপ্রেরণা পেতাম।

ওকে কখনোই প্রথম বেঞ্চে বসতে দেখিনি আমি। ও বসতো সবার পেছনে। এতটাই পেছনে বসতো যাতে কোনো টিচারের কথা ওর কানে না যায়। ক্লাশের একঘেয়ে পড়াশোনাকে বড্ড ঘৃ্না করতো ও। ক্লাশ মিস করায় ও ছিল সবার সেরা। ওর কথা হলো-

প্রতিদিন একই নাটক।
শিক্ষকের হাতে থাকবে চক।
মুখে থাকবে বকবক।
অকারণেই স্যারের পা করবে ঠকঠক।
আর ছাত্রছাত্রীদের বুকটা করবে ধকধক।

ওর এইসব ছন্দ শুনে আমরা হেসে উঠতাম কক কক করে।

ওর এই এলোমেলো স্বভাবের কারণেই হয়তো ওকে ভালো লাগতো বেশি। তবে মজার ব্যাপার হলো- কলেজের প্রতিটা পরীক্ষায় প্রথম হতো ও। এই ছেলেটা এত ভালো রেজাল্ট কীভাবে করছে- সেটা ছিল সবার কাছেই একটা বিস্ময়। কারণ, ওর হাতে গল্পের বই ছাড়া অন্য কোনো পড়ার বই কেউ কখনো দেখেনি।

ওর মাথায় সব সময় দুষ্ট বুদ্ধি ভর করতো। প্রায় সকল টিচারকে নিয়েই ছন্দ বানাতো ও।

এই তো কিছু দিন আগে আমাদের কলেজে কাউসার নামে এক স্যার এলেন। স্যার দেখতে খুবই সুন্দর। লম্বাও যথেষ্ট। সমস্যা হলো উনার মাথার সামনের দিকটায় চুল একেবারেই নেই। এই স্যারের আরেকটি সমস্যা ছিল- কোনো ছাত্রী উনার সামনে গিয়ে দাড়ালেই- উনি প্রথমে উনার চশমাটা চোখ থেকে নামাবেন। তারপর রুমাল দিয়ে চশমার কাঁচটা পরিষ্কার করবেন কয়েকবার। শেষমেষ চশমাটা আবার নাকের ডগায় বসাবেন। তখন এটা বুঝা কঠিন হয়ে যায়- উনি চশমার ভেতর দিয়েই দেখছেন নাকি খালি চোখে দেখছেন।

রাজিব করলো কি এই স্যারকে নিয়েও একটা কবিতা বানিয়ে ফেললো-

কলেজে এলেন নতুন স্যার
নাম তার Cow Sir (কাউসার)
ছাত্রীরা সামনে এলেই উনি যান দমে
উনার চশমার পাওয়ার যায় কমে।
উনি তাই কাঁচ ঘষেন বারবার
নাম তার Cow Sir (কাউসার)
চেহারাটা স্যারের কিন্তু একের
সবই তার ঠিকঠাক
শুধু ভুল করে চুল খসে
মাথায় পড়েছে টাক...

ওর এই কবিতা শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতাম আমরা। তবে যে ব্যাপারটা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করতো সেটা হলো- ও কখনো মেয়েদের সাথে মিশতো না। মেয়েদের থেকে চারশত গজ দূরে থাকার চেষ্টা করতো ও। মনে হতো- এ ব্যাপারে একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হয়েছে। এতটা মেয়ে-বিমুখ ছেলে আমি আর দেখিনি।

এটা বোধহয় চিরন্তন সত্যি একটা ব্যাপার- কলেজে যত মেয়েই থাকুক- দুই একজন মেয়ে থাকবে অপরুপ দেখতে। তাদের রুপের আগুনে ঝাপ দিয়ে ছাই হতে চাইবে অনেক ছেলেই। তেমন একটা মেয়ে ছিল- রিয়া তার নাম। 

পর্ব-২

আমি তো মাঝে মাঝেই মেয়েটার দিকে হা-করে তাকিয়ে থাকতাম। এতটা সময় ধরে হা-করে তাকিয়ে থাকতাম যে একবার একটা মাছি ঢুকে গিয়েছিল মুখের ভেতর। অথচ, রাজিবকে দেখেছি একেবারেই নির্বিকার। মনের ভুলেও তাকাতো না রিয়ার দিকে। রাজিবকে দেখে খুব হিংসা লাগতো আমার। আমি কেন ওর মতো হতে পারি না?

আমি রিয়াকে প্রেমের একটা চিঠি দেবো ভাবছিলাম। সমস্যা হলো আমি ভালো ছাত্র নই। কোনো কিছুই গুছিয়ে লিখতে পারি না। প্রেমের অফার সংক্রান্ত চিঠির শুরুটা কেমন হবে তাই গবেষণা করলাম দুই রাত।

- পত্রের শুরুতে আমার সালাম নিবেন।
- পত্রের শুরুতে আমার ভালোবাসা নিবেন।
- পত্রের শুরুতে জানাই শুভেচ্ছা।
- পত্রের শুরুতে জানাই ইত্যাদি ইত্যাদি .......

কোনোভাবেই আর পেরে উঠছিলাম না। তাই বাধ্য হয়ে ছুটে যাই রাজিবের কাছে। বলি, “দোস্ত, একটা চিঠি লিখে দে না? প্রেমের অফার রিলেটেড। কিছুতেই চিঠিটা গুছিয়ে আনতে পারছি না।”
- “কার কাছে দিবি এই চিঠি?”
- “রিয়াকে দেবো। জানিস তো ওকে দেখার পর থেকে আমার মাথা আর ঠিক নেই। জানি, ও হয়তো আমাকে ভালোবাসবে না। না বাসুক। নিজের ফিলিংসটা জানিয়ে রাখি। মরা শামুকে পা কাটতেও তো পারে, তাই না?”

একথা শোনার পরে ও আমকে একটা চিঠি লিখে দিলো এরকম-

রিয়া,

আমার ফ্রেন্ড ইমরান তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। সে সারাক্ষন তোমার দিকে হা-করে তাকিয়ে থাকে। হা-করে তাকিয়ে থাকা হচ্ছে ভালোবাসার ‘হাহিপ্রকাশ’‘হাহিপ্রকাশ’ হচ্ছে বহিপ্রকাশের চেয়ে বেশি কিছু। তুমি যদি আমার বন্ধুটাকে ভালোবাসো- সেটা ভালো। আর যদি ভালো না বাসো- সেটা আরো ভালো।


ইতি

রাজিব

চিঠিটার উত্তর রিয়া আমাকে দেয়নি। দিয়েছিল রাজিবকে। সেই চিঠিটা রাজিব আমাকে পড়তে দিয়েছিল। যাতে লেখা ছিল-

রাজিব,

তুমি ভাবলে কি করে ইমরানের মতো গাধা টাইপের একটা ছেলেকে ভালোবাসবো আমি। ওর চেহারাটা সুন্দর। মনটাও হয়তো সুন্দর। কিন্তু ও তোমার মতো ইন্টিলিজেন্ট নয়। তবে আমি খুব লাকি যে স্টুপিডটা তোমাকে দিয়ে চিঠিটা লিখিয়েছে। তুমি যে আসলেই অসাধারণ ব্রিলিয়ান্ট তার প্রমান ঐ ‘হাহিপ্রকাশ’ শব্দটা।


চিঠি যখন লিখতেই বসেছি তখন একটা সত্য স্বীকার করেই শেষ করবো। একথা মোটেই অসত্য নয় যে, অনেক ছেলেই আমার পেছনে ঘুরে। তবে তাদের কাউকেই আমার পছন্দ নয়। আমার ভালো লাগে তোমাকে। তোমার বুদ্ধিমত্তা, তোমার রেজাল্ট এবং দাড়ি শোভিত চাঁদের মতো মুখ- সবই আমাকে তীব্র আকর্ষণ করে।


তুমি আমাকে ভালোবাসো বা না বাসো দয়াকরে কখনো দাড়ি কাটবে না। দাড়ি কাটলে তোমাকে এত সুন্দর লাগবে না দেখতে। দাড়িওয়ালা ছেলে আমার আজন্ম অপছন্দের। তবে তোমাকে দেখার পর ধারনা পাল্টে গেল। কল্পনাতেও ছিল না দাড়িওয়ালা মানুষ এত সুন্দর দেখতে লাগতে পারে।


আই লাভ ইউ রাজিব।


ইতি

রিয়া

চিঠিটা পড়ে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। রাজিবের দিকে তাকিয়ে থাকি অনিমেষ। সত্যিই তো দাড়ি শোভিত রাজিবের মুখখানা চাঁদের চেয়েও বেশি সুন্দর। ভেবে দেখলাম- আমি যদি কোনো মেয়ে হতাম- অবশ্যই রাজিবকে ভালোবাসতাম। তাই রিয়াকে কোনো দোষ দিলাম না। মনটাও খারাপ করলাম না। বরং ভাবছিলাম- আজ থেকে আমিও দাড়ি রাখা শুরু করবো। প্রেমের ক্ষেত্রে দাড়ি কোনো বাধা নয়।

রাজিব কিন্তু রিয়ার ডাকে সাড়া দেয়নি। ঐ চিঠির উত্তরও সে দেয়নি কোনোদিন।

ভালোবাসাহীন এক অদ্ভুত জগতে রাজিবের সাথে বসবাসের চেষ্টা করলাম আমিও। দাড়িও রাখা শুরু করলাম। পড়া ধরলাম গল্পের বই। দেখলাম সময় কেটে যাচ্ছে। সময় কেটে যায়। সময়ের নিয়মই এমন।



করুণ কাহিনি

ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে আমরা দু’জনেই টাঙ্গাইল সা’দত কলেজে ভর্তি হই। ও অবশ্য জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটিতে ফিলোসফিতে চান্স পেয়েছিল। ওর মনমতো সাবজেক্ট না পাওয়াতে, ভর্তি হয়নি ওখানে। আমি মনে মনে এমনটাই চেয়েছি যাতে ও অন্য কোথাও ভর্তি না হয়। দু’জনেই পড়া শুরু করলাম ইংলিশ লিটারেচার। ঢুকে গেলাম সাহিত্যের অনন্য এক জগতে।

সেকেন্ড ইয়ারে উঠবার পর নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। আমাদের একটা সাবজেক্ট ছিল যার নাম ‘রোম্যান্টক লিটারেচার’। শেলী, কীটস, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ- ওদের কবিতা পড়ে এক অদ্ভুত রোম্যান্টকতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো মন। দেখলাম মনের দরজায় আর তালা মেরে রাখা যাচ্ছে না। চোখজোড়া আর কোনো বাধা মানছে না। প্রেমে পড়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার আদর্শ ছিল রাজিব। ওর হার না মানা স্বভাব তখনো ছিল।

ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল রাজিব। ওকে বন্ধু কিংবা প্রেমিক হিসেবে চেষ্টা করতো অনেক মেয়েই। কিন্তু পারেনি। ওর কথা হলো- জীবনে ভালোবাসা যায় দু’টি মাত্র জিনিসকে- সেটা হলো- ‘বই এবং বউ’- এছাড়া আর কাউকে নয়।

পুরো কলেজ ক্যাম্পাসটা যখন ভালোবাসার স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল- তখন দেখলাম, ও একটা কবিতা টানিয়ে রেখেছে ওর পড়ার টেবিলের সামনের দেয়ালে। কবিতাটা এমন-

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে
ভালোবাসার সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দেই।
ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেই-
শত শত প্রেমিকের রক্তে গড়া
ভালোবাসার টুইন টাওয়ার।

তারপর হবো ইতিহাস।

হবো ইতিহাস।

ভালোবাসার উপরে ওর এতো ক্ষোভ কেন তা বুঝতে পারতাম না আমি। ওকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে শুধু বলতো-

পৃথিবীতে আসলেই
প্রেম বলে কিছু নেই।
আজ যে মোর
কাল সে তোর।
আজ যে কাছে
কাল সে দূর......

ফোর্থ ইয়ারে পা দেওয়ার পর ওর মাঝে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। এই পরিবর্তন আমি কল্পনাতেও করার সাহস পাইনি .....

পর্ব-৩


আমি থাকতাম উত্তরা হলে। আর ও থাকতো সিএম হলে। ওর সাথে দেখা হতো প্রায় প্রতিদিন। মাঝখানে সপ্তাহ খানিকের মতো ওর সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো না। ফোন করেও পাচ্ছিলাম না ওকে।

ওর সাথে দেখা হলো সেদিন। দেখি দাড়িগুলো অনেক খাটো করে ফেলেছে ও। ওর চুলগুলো ছিল কাজী নজরুলের মতো বাবরী দোলানো। সেই চুলও আর সেরকম নেই। অনেক খাটো করে ফেলেছে। ওকে দেখে আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল- ভুল দেখছি আমি। আমি ওকে বললাম, “রাজিব, আমি তো ভাবতেই পারছি না- তুই এতোটা বদলে গেছিস এই ক’টা দিনে। হঠাৎ বাউন্ডুলে ভাবটা ছাড়ার কারণ কি? তবে এখনো তোকে দেখতে কিন্তু চমৎকারই লাগছে।”

রাজিব বলল, “আমি হেরে গেছি ইমরান। আজ এই চব্বিশটা বসন্ত শেষে এসে বুঝলাম- ভালোবাসার শক্তি আদি অন্তহীন।”
আমার ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল অপার বিস্ময়ে।
- “মানে?”
- “মানে আমি প্রেমে পড়ে গেছি ইমরান।”
- “কার প্রেমে?”
-  “রিয়ার।”

দেখি, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাচ্ছে দ্রুত। সামনে দেখি সেই সোনালি সময়। রিয়া। যাকে প্রথম দেখে- সেই প্রথম যৌবনে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। যাকে পটানোর চেষ্টা করেছিলাম বোকার মতো। সেই মেয়েটি এখনো ভুলেনি রাজিবকে?
এও কি হয়?
এটা কি বিশ্বাস করা যায়?

বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম- রিয়া যদি সত্যিই রাজিবকে এখনো ভালোবেসে থাকে তাহলে এই ভালোবাসা মেকি নয়। যেখানে একটি চিঠি লেখার যে সময়- সেই সময়ের ব্যাবধানে নারীর হৃদয় তিনবার বদলায়- সেখানে রিয়া প্রায় ছয়টি বছর ধরে ভালোবেসে চলেছে রাজিবকে।

ভালোবাসা বলতে একটা জিনিস এখনো তাহলে আছে?
হঠাৎ-ই ভীষন মিথ্যে মনে হলো রাজিবেরই লেখা একটা কবিতার শেষাংশ-

আকাশের রঙের আগেই
নারীর মন বদলয়ায়।
এই আলতু ফালতু যুগে
ভালোবাসে কোন শালায়?

তারপরের দিনগুলো রাজিবের জন্য হয়ে গেল রোমাঞ্চ জাগানিয়া। আমার প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে গেল বিবর্ণ। হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে- তাকিয়ে থাকতাম দিগন্ত পানে। এক অন্তহীন নিঃসঙ্গতা কুড়ে কুড়ে খেতো আমাকে। শুধু জানতে ইচ্ছে করতো- 'রাজিব, তুই ভালো আছিস তো?'

তারপরে খুব দ্রুত কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম রাজিবের মাঝে। একদিন দেখলাম দাড়িগুলো পুরোপুরি কামিয়ে ফেলেছে ও। ফর্সা মুখটা মনে হয় আরো ফর্সা হয়ে বেরিয়ে আসলো। অন্য একদিন দেখলাম জিম থেকে বেরিয়ে আসছে ও। তারপর আরেক দিন দেখলাম জেন্টস পার্লারে।

প্রেমে পড়লে মানুষের মন বদলায় শুনেছি। শরীরের চামড়াগুলোও যে প্রলেপ দিয়ে, চেচে মুছে পরিষ্কার করতে হয়- রাজিবকে দেখে সেটা বুঝলাম।

বদলে গেল সময়।
বদলে গেল রাজিব।
আর এক গাল দাড়ি নিয়ে- নিজেকে ভুলে যাবার অন্তহীন প্রয়াসে- আমি ডুব দিলাম সাহিত্যের সাগরে।

প্রায় একটা বছর ওর সাথে আমার আর যোগাযোগ ছিলো না। তখন আমি মাস্টার্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

একদিন সকাল বেলায় নাস্তা করতে যাবো- এমন সময় দেখলাম প্রায় আশি হাত দূরে এক কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে আছে। তবে অবাক হচ্ছিলাম- কাকতাড়ুয়াটা দেখতে ঠিক মানুষের মতোই। পরনে শার্ট, প্যান্ট এবং পায়ে জুতো পর্যন্ত। চিকন একটা বাঁশের  উপর মানুষের মাথার মতো কি একটা গোল যেন বসানো ছিল। কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম- এটা কাকতাড়ুয়া নয়। এ যে আমাদের সেই রাজিব! কী হাল হয়েছে ওর! নিজের চোখকে বিশ্বাস করা খুব কঠিন মনে হচ্ছিল। আমি রাজিবের হাতটা ধরলাম। তারপর বললাম, “তোর এই অবস্থা কেন? এমন তো ছিলি না তুই? শুকিয়ে একেবারে বাঁশের চেয়ে চিকন হয়ে গেছিস।”

ও কিছু বলল না। হয়তো ও কিছু বলতে পারলো না। আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে খুব দ্রুত সরে গেল ওখান থেকে। আমি কোনো হিসেব মিলাতে পারলাম না। জীবনের কোনো হিসেবই মিলে না গাণিতিক নিয়মে।


নেশাগ্রস্ত রাজিব


এর ঠিক আঠারো দিনের মাথায় একটা চিঠি পেলাম রাজিবের।

ইমরান,

আমি শেষ হয়ে গেছি। এভাবে শেষ হয়ে যাবো কখনো ভাবি নি রে। একটা ছোটো গল্পের মতো হঠাৎ শুরু আমার জীবনের। আর ছোটো গল্পের মতো তার হঠাৎ-ই শেষ।


যে সত্যটা আমি কাউকে বলি নি, এমনকি তোকেও নয়- আজ সেটা তোর কাছে বলবো। আমি এক হত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আমাদের  ঘরটা ছিলো ছনের। ছোটোবেলায় দেখতাম যখনই কোনো ঝড় হতো- আমাদের মনের সাথে সাথে ঘরটাও কাঁপতো থর থর করে। ক্লাশ সেভেনে পড়ার সময় জসিম উদদীন এর একটা কবিতা নকল করে কয়েকটি চরন লিখেছিলাম এরকম-


তুমি যাবে, যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে

আমাদের কুঁড়ে ঘরে
যে ঘরে বৃষ্টি এলেই বৃষ্টি পড়ে।

এই সীমাহীন দারিদ্রতাই আমাকে দূরে রাখতো সবার কাছ থেকে। তাই ইচ্ছে করেই  মেয়েদের সাথে মিশতাম না। আমার কেবলি মনে হতো অর্থ (টাকা) ছাড়া কোনো কিছুরই অর্থ নেই।


হার না মানা এক স্বভাব ছিল আমার। তাই শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পড়াশোনা ছাড়িনি। সেই ক্লাশ

সিক্স থেকে টিউশন শুরু করি। যখন ক্লাশ নাইনে পড়তাম তখনই পড়াতাম ক্লাশ টেন-এর এক ছেলেকে। রিয়েলি, যথেষ্ট মেধাবী ছিলাম আমি।

তোর মতো আমারও একটা মন ছিল। কিন্তু সেই মনের দরজায় মস্ত এক তালা ঝুলিয়েছিলাম। কেননা, কারো ভালোবাসা পাবার যোগ্য আমি ছিলাম না। এই যান্ত্রিক পৃথিবীতে ভালোবাসা পেতে কিংবা দিতে বুক বোঝাই ভালোবাসা নয়, লাগে পকেট বোঝাই টাকা। কিন্তু নিজের এই অক্ষমতা, অযোগ্যতা কিংবা দারিদ্রতা কারও কাছে প্রকাশ করতে চাইতাম না আমি। তাই কৌশলে শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। সেটাই বোধহয় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার জীবনে।


কারো ভালোবাসা পাবো না বলেই হয়তো ভালোবাসার বিরুদ্ধে লেখালেখি করে মনের রাগ ঝাড়তাম আমি।

তারপরেও- আমার একটা মন ছিল।
সেই মনটা মাঝে মাঝেই সন্তানশূন্য মায়ের বুকের মতো খা- খা করতো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য।

তাই ছয়টি বছর পরেও যখন দেখলাম- একটা মেয়ে এখনো আমার পথ চেয়ে বসে আছে তখন সেই পথে হাটা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলো না। যদিও জানতাম এই পথটা মোটেই মসৃণ নয়। ভীষণ বন্ধুর। দুর্গম। বড়ো সচেতনভাবে ভুল জায়গায় ফুল দিলাম আমি।


ভালোবাসা পেয়ে বুঝলাম- ভালোবাসা ভালো নয়।

টানা একটা বছর ভালোবাসার জলে সাঁতার কেটে দেখলাম- এর কোনো কিনারা নেই। এ যে সীমাহীন। তাই তীরে তরী ভিড়লো না আমার।

ওরা যে এতো বড়লোক- এটা ছিলো অকল্পনীয়। ভেবেছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হবে ও। কিন্তু দেখলাম- তা নয়। ধনীর দুলালী। ওর বাবা মা’র ধারনা- আমি রিয়াকে পটিয়েছি রাজ্য ও রাজকন্যা একসাথে পাবার আশায়।


ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল ভীষণ বড়লোক এক ছেলের সাথে। ছেলেটা জব করে জাতিসংঘের সচিবালয়ে। স্যালারি বাংলাদেশি টাকায় চার লক্ষ ত্রিশ হাজার। এমনটা হয়েছিল কারণ রিয়াও তো কম সুন্দরী নয়। এমন সুন্দর একটা মেয়ে ও! ওর পাশে ঐ লোকটা আর টাকার পাহাড়টা চমৎকার মানায়।


ভালোবাসা তাই মুখ থুবড়ে পড়ে।


আমি নিজেকে সরিয়ে নেই।  আমার মতো অযোগ্য, অপদার্থটাকে ওর পাশে একটুও মানায় না।


বিয়ে হয়ে গেল রিয়ার। শুনেছি অনেক নাকি কেঁদেছিল সেদিন। একমাস পরে নাকি দেখা গেছে হাজব্যান্ডের সাথে হাসতে হাসতে শপিং করছে ও। নিজেকে তাহলে বদলাতে পেরেছিল রিয়া? অবাক লাগেনি আমার।


কিন্তু এই একটা বছরের অন্তহীন ভালোবাসা, কথা বলা, স্বপ্ন দেখা- সবই সারাটাক্ষন তাড়িয়ে বেড়াতো আমাকে।


ওকে ভুলে যাবার অদম্য বাসনা থেকে প্রথমে বই পড়া শুরু করি। দেখি- প্রতিটি বইয়ের প্রতিটি পাতা ওর মুখ হয়ে ভেসে উঠছে আমার সামনে।


তারপর বই ছেড়ে ধরি সিগারেট। সিগারেটের প্রতিটি টানে, ধোঁয়ার মাঝেও দেখি ওর সেই হাসি হাসি মুখখানা।


মনে হতো- যদি স্মৃতি শক্তি লোপ না পায়- তাহলে ওকে কোনোদিন ভুলতে পারবো না আমি। যতই ভুলে যেতে চাই, ততই মনে পড়ে।


তারপর ধরলাম মদ।

তারপর হেরোইন।

এই ভয়াল মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য ঢুকে গেলাম অপরাধের অন্ধকার জগতে।


রিয়ার এসব কিছুই আর জানবার কথা নয়।


ইতি

রাজিব

চিঠিটা পড়ার পরে দু’চোখ ভিজে গেল আমার।

সেদিন বিকেলেই ওদের গ্রামের বাড়ি যাই আমি। গ্রামের প্রায় সবাই ওকে চিনে। ওদের বাড়ি চিনতে তাই সমস্যা হলো না। সবার মুখে একই কথা শুনলাম- “বড়ো ভালো ছিল ছেলেটা। কেন যে এভাবে নষ্ট হয়ে গেল?”

দেখি সত্যিই একটা ঘর। যার উপরে ছনের চাল। ঘরের সামনে চৌকাঠে বসা মধ্যবয়স্কা এক নারী। ধারনা ভুল হলো না আমার- মহিলাটা রাজিবের মা। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “রাজিব কোথায়? বাসায় নাই?”

মহিলাটির বুকের পাঁজর মনে হয় ভেঙে গেল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো চোখের জল। কোনো শব্দ করলো না। হাতের ইশারায় আমকে সামনে যেতে বলল।

দেখি একটা কবর।
বুঝাই যায় কবরটা একেবারে নতুন। হ্যা, দু’দিন আগের। এই তো দু’দিন আগে- ক্রস ফায়ারে মারা গেছে রাজিব।

একটা কবরের সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ি আমি। পুরো পৃথিবীটা ঘোলাটে হয়ে আসে পশ্চিম আকাশের শেষাশেষি সূর্যটা ক্রমশ ম্লান হচ্ছে। অস্ত যাবে এখনি। সেই অস্তায়মান সূর্যের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে হাস্যোজ্জ্বল একটা মুখ। মুখটা রাজিবের। দাড়ি শোভিত। ভীষণ পবিত্র। কানের কাছে শুনতে পাই ভরাট কন্ঠে আবৃত্তি করছে ও-

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে
ভালোবাসার সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দেই।
ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেই-
শত শত প্রেমিকের রক্তে গড়া
ভালোবাসার টুইন টাউয়ার।

তারপর হবো ইতিহাস।

হবো ইতিহাস।

সূর্যটা হারিয়ে যায়। আমি হাটু গেড়ে বসে থাকি। নিশ্চল। নিথর।

পরের দিন।

কলেজের মাঠটায় দাঁড়িয়ে থাকি আমি।
ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া একটা গাছের মতো।
নিঃশব্দে।

তাকিয়ে দেখি- সমস্ত কলেজ মাঠটা জুড়ে শত শত তরুণ তরুণী বসা। জোড়ায় জোড়ায়।

কিছুই বদলায়নি।
কিছুই বদলায় না।
কেউ বেঁচে থাকলে।
কিংবা কেউ মরে গেলেও ......

লেখা- ওয়াদুদ খান
সদরপুর, ফরিদপুর 
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

Sunday, 27 August 2017

ওরাও মানুষ (ভাগ্য শুধু করলো প্রবঞ্চনা)


তোমরা যারা পাঁচতলাতে
বসে ভাবছো, "আমরা মানুষ।"
বুঝবে কি আর গাছতলাতে
যারা আছে, তারাও মানুষ?


রাখাইনের মংডু গ্রামেও
লাল রক্তের মানুষ থাকে।
হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ
সবাই মানুষ- মারছো কাকে?



সূত্র: প্রথম আলো (২৮/০৮/১৭)


জ্বলছে মানুষ, পুড়ছে মানুষ
মরছে মানুষ, মানবতা
রক্ত লাল নহর দেখেও
মানুষেরই নিরবতা।


জগতজুড়ে এত মানুষ
তবুও মানুষ খুঁজে যাই।
দেখতে লাগে মানুষ মানুষ
আসলে আর মানুষ নাই।

ওয়াদুদ খান
সদরপুর, ফরিদপুর
২১ নভেম্বর, ২০১৬

মৃত্যু (একদিন মাটির বিছানা হবে ঘর!)


চেয়ে দেখি হঠাৎ করে
আজরাইল দাঁড়িয়ে দ্বারে
নিয়ে যেতে এসেছে ও রে
প্রাণপাখি মোর জনমের তরে।

এ পৃথিবী ছেড়ে একদিন
যেতে হবে একা, সঙ্গীবিহীন
ঘুরেছি ফিরেছি আমি
ভাবিনি তো কোনোদিন!

খাটিয়া 


আজরাইলকে দেখে
বললাম ডেকে,
" ও ভাই,
যাবার ক্ষণে কিছু বলে যেতে চাই।"

একটুও দেরী  না করে
আমার গলার মধ্যে ধরে
বলে, "ব্যাটা, হায়!
তোর সময় আর নাই।"

একটু সময় না দিয়ে আমায়
দেহ হতে প্রাণপাখি নিয়ে যায়।
রওনা হলাম আজকে সেথায়
শুরু আছে, শেষ নাই কো যেথায়।

এতকাল আহা
ভেবেছিনু আমার যাহা
রইলো পড়ে তার সবই।
মূল্যহীন জিনিসেরে
দাম দিয়েছিনু খুবই।

[বি.দ্র. হাইস্কুলে যখন পড়তাম, তখন এই কবিতাটি লিখেছিলাম।]

আসুন, স্রষ্টায় (আল্লাহ) বিশ্বাসী হই। মন থেকে ঝেড়ে ফেলি অবিশ্বাসের কীট।

লেখা: ওয়াদুদ খান
সদরপুর, ফরিদপুর
২২ এপ্রিল, ২০১৬

আমি যখন কলেজ টুডেন্ট (স্টুডেন্ট)

এতদিন তাও সহ্য হচ্ছিল।
ইন্টারে ভর্তি হবার পর মাথায় আর কাজ করছিল না। প্রেমের জোয়ারে সবাই ভাসছে। শুধু আমি একাই সিঙ্গেল সবার প্রেম কাহিনি শুনতে শুনতে আমিও প্রেমকাতর হয়ে গেলাম।

কিন্তু আমার সাথে কে প্রেম করবে? মেয়েদেরকে পটানোর মতো লুক আমার নেই। আবার আমার মানিব্যাগের অবস্থাও করুণ।

আমার উচ্চতা ৫ ফিট ১ ইঞ্চি। গায়ের রঙ এবং ফিটনেসের কারণে বন্ধুরা আমাকে বলতো অভিনেতা 'হাসান মাসুদ'। আর মেয়েরা আড়ালে ডাকতো 'কাইল্যা বাইট্ট্যা' বলে।
আমার মতো কালো, খাটো, আনস্মার্ট ছেলেকে ভালোবাসবে এমন সখিনা টাইপের মেয়ে এই কলেজে নেই। প্রেমের নদীতে সাঁতার এবং হাবুডুবু খাবার জন্যে তবুও অস্থির হয়ে গেলাম।
অবশেষে বুদ্ধি পেলাম দোস্ত সুজনের কাছে। ও দেখতে সুন্দর, স্মার্ট।  লম্বাও যথেষ্ট। আমরা ওকে 'লাভার বয়' বলে ডাকতাম। মেয়েরা ওর নাম দিয়েছিল রোমিও। মেয়েদেরকে পটানো এবং ওদের মুখে 'ভালোবাসি' শব্দটাকে ফোটানো ও নিয়েছিল শিল্পের পর্যায়ে ।
সুজনের বুদ্ধিতে নতুন একটা ফেক আইডি খুললাম ফেসবুকে। আমার প্রোফাইলে লাগালাম হ্যান্ডসাম এক ছেলের পিকচার । অনেকগুলো পিকচার কালেক্ট করলাম ছেলেটির- যাতে মাঝে মাঝেই প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করতে পারি। কলেজের নাম দিলাম নটরডেম।
মেয়েদের নাম দেখলেই পাঠাতাম ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট । ছবি না দেখেই কমেন্ট করতাম - অসাম, কিউট, ফাটাফাটি.......ব্লা ব্লা ...... 
শেষমেশ আমার ফেসবুকের আকাশে জমলো মেঘ। এল প্রেমের বৃষ্টি । দিলাম ডুব। কাটলাম সাঁতার । আহ কী সুন্দর ভালোবাসা!
এখন আর আমি মুমিনের হোটেলের সামনে হা করে দাঁড়িয়ে থাকি না। যাই না মহিলা কলেজের গেটেও ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে মেয়েদের ফোন নাম্বার কালেক্ট করে রাতে কল করার দিন শেষ।আমি থাকি এখন ভদ্র পল্লীতে। চায়ের দোকান কিংবা খেলার মাঠে আমাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।আমি থাকি নেটে । থাকি চ্যাটে ।


কলেজ জীবন

সাবাশ ফেক আইডি।
সাবাশ ফেক প্রেম ।
ছয় মাস চুটিয়ে ফেসবুকের প্রেম সাগরে হাবুডুবু খেয়ে বুঝলাম-,আমার প্রেমিকাও ফেক । যখন ফোনে কথা বলতে চাইলাম, দেখা করতে চাইলাম তখন সে বাধ্য হয়ে সত্যটা স্বীকার করলো-
"দেখুন, আমি আপনার মতো প্রেম পাগল এক ছেলে । অনেক মেয়েকে হাই, হ্যালো করেছি কিন্তু পাত্তা পাইনি । স্টাটাসে, পিকচারে লাইকই পেতাম না । আর এখন 'হাই' লিখে স্টাটাস দিলেও লাইকের বান ছুটে, কমেন্টের বন্যা হয়। সরি ব্রাদার.... "
আর কি বলেছিল 'নীল পরী নীলাঞ্জনা' নামের ছেলেটা- আমার তা মনে নেই।
আমাকে ইদানিং আবার চায়ের দোকান, মুমিনের হোটেল কিংবা ফ্লেক্সিলোডের
দোকানের আশেপাশে নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে ......
ধোকা খেয়ে
বোকা হবার মতো
ছোট্ট খোকা আমি নই...
আমরা নই...


লেখার তারিখ - ১৪ আগস্ট, ২০১৪