Monday, 11 December 2017

আমরা গরিব- রয়ে গেলাম ওদের কাছে ফেলনা! (কবিতা)


খেলনা চাই
খেলনা দাও


বাচ্চা মেয়ে মাকে ডেকে কেঁদে বলে, "ও মা, 
কত্ত সুন্দর কিনছে পুতুল পাশের বাসার ঝুমা! 
হাসে পুতুল, নাচে পুতুল, কাঁদেও পুতুল ওটা
ডাকলে তারে কথাও বলে, শুরু করে হাঁটা।
ছোঁয়া দিলে নড়ে ওঠে ঠিক আমাদের মতো
দেখলে পুতুল দূর হয়ে যায় মনের যত ক্ষত।
দাও কিনে মা ওই পুতুলটা, দাও না প্লিজ কিনে
ভাল্লাগেনা কিছুই এখন ওই পুতুলটা বিনে।"
যায় হারিয়ে গরিব মায়ের সকল কথা মুখের
সান্ত্বনা সে পায় না খুঁজে, ঝরে পানি চোখের।


বাচ্চা মেয়ে যাচ্ছে বলে, "চুপ আছ ক্যান মা? 
পুতুলটাকে দেয় না ছুঁতে পাশের বাসার ঝুমা।
দেখিয়ে আমায় পুতুলটারে দু গালে দেয় চুমা।
লাগলে তোমায় দেবো আমার পাঁচটা কয়েন জমা।
দাও কিনে মা ওই পুতুলটা, দাও না প্লিজ কিনে
ভাল্লাগেনা কিছুই এখন ওই পুতুলটা বিনে।" 
বলতে গিয়ে গরিব মায়ের কথাগুলো যায় জমে
ঝরলে অশ্রু তবেই যেন দুঃখ একটু কমে
কোলে নিয়ে বাচ্চাটাকে মা শুধু বলে এই--- 
"গরিব আমি- পুতুল কেনার সাধ্য আমার নেই। 
ধনী ওরা ওদের আছে হাজার রকম খেলনা
আমরা গরিব রয়ে গেলাম ওদের কাছে ফেলনা।
স্বপ্ন-সাধ সবই আছে নেই তো মোদের সাধ্য
রোজ অপমান ওদের কাছে হতে মোরা বাধ্য।" 
বাচ্চা মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে বোঝে না সে কিছু
রোজ সকালে বৃথাই ঘুরে ঝুমার পিছু পিছু...

(আসুন, আমাদের বাচ্চাদের গরিব-অনাথ শিশুদের সাথে খেলতে শেখাই)

ওয়াদুদ খান
সদরপুর, ফরিদপুর
০৮ ডিসেম্বর, ২০১৭

Sunday, 10 December 2017

আপনার বাচ্চা কি স্কুলে যায়? এ প্লাস পাবে?

এলোমেলো ভাবনা

বিচিত্র চিন্তা


ছেলের বয়স পাঁচ পেরিয়ে এখন পা রাখল ছয়ে। স্কুলে দেইনি এখনো। এজন্য সমালোচনার অন্ত নেই। অনেকেই বলেন, "আরে, আমার বেবিকে তো ৪২ মাস বয়সেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দিয়েছি। আর আপনার বাবুর তো ৬১ মাস চলে.... "

"ভালো স্কুল" বলতে ঠিক কি বোঝায়- আমি আমার জীবনের প্রায় ৩৮৪ মাস অতিবাহিত করেও আজও ঠাহর করতে পারলাম না। ছোট্ট বাচ্চারা যখন পিঠ বাঁকা করে বই নিয়ে স্কুলে যায়, এই দৃশ্য দেখে আমার দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। তথাকথিত পড়ালেখার চাপ আমার বড্ড অপছন্দ। "ক্লাসের ফার্স্ট বয়"- মানেই ব্রিলিয়ান্ট- আজও এটা মেনে নিতে পারলাম না।

আমি পাগলের মতো একটা পাঠশালা খুঁজি- যার পাশ দিয়ে বয়ে যাবে ছলাৎ ছলাৎ নদী, সামনে থাকবে অবারিত সবুজ খেলার মাঠ। পড়াশোনা বলতে যেখানে বাচ্চাদের খেলাধুলাই বোঝাবে। পাই না এমন স্কুল আর।

আজ থেকে প্রায় ৩২৮ মাস আগে আমিও স্কুলে গিয়েছিলাম। সবুজ মাঠের পর মাঠ ছিল। ছিল চার পাশে অগ্রাহায়নের ধান।

কতো পার্থক্য আজ। আজকের শিশুদের দিকে তাকালে বড্ড মায়া হয়। বাবা হিসেবে বড্ড অসহায় বোধ করি।

ছবি: ইন্টারনেট 
সরকারেরও এ ব্যাপারে কোনো সুদৃষ্টি নেই। পিইসি কিংবা জেএসসি পরীক্ষা অভিভাবকদের মাঝে এক ইঁদুর-দৌড় তৈরি করেছে। বাচ্চাটাকে এ প্লাস পেতে হবে। এজন্য বছরজুড়ে চলে প্রাইভেট, কোচিং, হোম-টিউটর ইত্যাদি। আবার পরীক্ষার আগে ফাস হওয়া প্রশ্নপত্র পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের সাথে মাঠে নেমে যাচ্ছেন অভিভাবকবৃন্দ। বড্ড হতাশ হই।

আমার ছেলেটাকে পুঁথিগত বিদ্যা নয়, বরং সত্যিকারের কিছু শেখাতে চাই। কিন্তু, তেমন পরিবেশ কি পাব?

সেদিন শুনলাম, প্লে গ্রুপে ভর্তি হতেও নাকি কোচিং করতে হয়। স্কুলে যাবার আগেই কোচিং! কোথায় যাচ্ছে স্বদেশ? প্লে গ্রুপে ভর্তি হতে নাকি ঢাকার স্কুলগুলোতে হাজার বিশেক টাকাও লাগে। মাসিক ফি তো আছেই। লেখাপড়া কেমনযেন পণ্য পণ্য লাগে। গরিব, মধ্যবিত্ত পরিবারের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা। 

ছেলেকে স্কুলে দেবার আগে মাথায় হাজারও প্রশ্নেরা ভিড় করছে। উত্তর পাই না।


ওয়াদুদ খান
১১ ডিসেম্বর ২০১৬
সদরপুর, ফরিদপুর

Wednesday, 6 December 2017

জেলে (JAIL) যাচ্ছে জেলে (FISHERMAN) ! (রম্য কবিতা)

দেশে এখন হচ্ছেটা কী?
শরম লাগে- ভাবতে গেলে
রক্ষকেরা খাচ্ছে গিলে
চুরির একটু সুযোগ পেলে।
সন্ত্রাসীদের কদর ভীষণ
মাছ ভেজে খায় গরম তেলে।
আইনের ওই ফাঁকফোকরে
জেলে (jail) দেখি যাচ্ছে জেলে (fisherman)! 


ছাকিপ খোকাও হচ্ছে চরম;
অপুটাকে নরম পেয়ে
শরীরে ওর চর্বি জমা
তিনবেলা রোজ গরম খেয়ে।




নষ্ট লোকের মিষ্টি জুটে
ভদ্রলোকের জুটছে মুলা
কাজের বেলায় ঠন-ঠনাঠন
খালি ওদের সেল্ফি-তোলা।

ঘাস খেয়ে যায় আমজনতা 
বাটপারেরা খাচ্ছে হাঁস
পকেট ওদের হচ্ছে ভারী
দেশের পিছে দিচ্ছে বাঁশ।

কবি ও কথাশিল্পী 
০১৭৮৫৫৬২০৮০


Tuesday, 28 November 2017

'ক্যাডার' থেকে 'ক্যাডার' হওয়ার গল্প


পর্ব- ১
সেদিন ফুটবল খেলা চলছিল কলেজ মাঠে। জমে উঠেছিল ম্যাচ। টানটান উত্তেজনা। নীল দলের এক খেলোয়ার লাল দলের ডিবক্সে ঢুকে গেল। সমস্ত দর্শক চিৎকার করে উঠল, "গোওওওওওল...."। কিন্তু না, লাল দলের এক খেলোয়াড় হাত দিয়ে ফিরিয়ে দিল বলটি। দর্শকের দৃষ্টিতে পড়লেও, রেফারির দৃষ্টিতে পড়েনি। রেফারির দায়িত্ব পালন করছিলেন সবার প্রিয় নরেশ চন্দ্র স্যার। তিনি ক্রীড়ামোদী। নিরপেক্ষ ও দক্ষ হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত। 

নীল দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। আপেল নামের এক খোলোয়াড়, যাকে সবাই কাটা আপেল  নামেই চিনে, নরেশ স্যারের কলারে ধরে ফেলল। বলল, "ঘুষ খাইছস হালার পো।"  সবাই অবাক। হতভম্ব। একি! শিক্ষকের কলারে ধরল এক ছাত্র! লাল দলের খেলোয়াড় পালটা আক্রমণ করতে আসল। 

কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখা গেল, কাটা আপেল  এক ছাত্রের পিঠ বরাবর ছুরি চালিয়ে দিয়েছে। কলকল রক্ত ঝরছে। একটু দূরেই দেখা গেল নরেশ চন্দ্র স্যার মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। কে যেন দূর থেকে স্যারের মাথা বরাবর ইট ছুড়ে মেরেছে। কিছু ছাত্র অসহায় দৃষ্টিতে নিরাপত্তা দিতে স্যারকে ঘিরে রেখেছে।

তারপরেও অনার্স, মাস্টার্স কমপ্লিট করতে পেরেছিল কাটা আপেল 

পর্ব- ২

টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, একাধিক ধর্ষণ, কয়েকটি খুনের অভিযোগ নিয়ে সাধারণের মনে ক্যাডার  হিসেবে জায়গা করে নেয় সে। ভীতি ও ত্রাসের কারণে সালাম তাকে অনেকেই দেয়।

একদিন তার খায়েশ হলো, নামের আগে অধ্যক্ষ বসাবে। কিছুদিন পর উপজেলা চেয়ারম্যান পদের সম্ভাব্য প্রার্থী সে। "অধ্যক্ষ আপেলকে ভোট দিন"- ভাবতেও তার ভারি আনন্দ হয়।

এলাকার এমপি কামাল জমাদ্দার। ছাত্রজীবনে তার পরিচিত ছিল কোপা কামাল  হিসেবে। তার সাথে পরামর্শ করে এলাকায় এক প্রয়াত রাজনীতিকের নামে কলেজ প্রতিষ্ঠা করে কাটা আপেল  ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। নিজেই হয় প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। সাঙ্গপাঙ্গদের যোগ্যতা ভেদে নানান পদ দেয়া হয়। সবকিছুই জায়েজ করা হয় কিছু পরিকল্পিত ছকে।

তারপরের ইতিহাস পাঠকের অজানা নয়।

কলেজ জাতীয়করণের মাধ্যমে আবার নতুন করে ক্যাডারের খাতায় নাম লেখায় কাটা আপেল। এখন তার নাম খন্দকার আপেল মেহমুদ। নামের পরে বসায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার। 

শোনা যায়, অচিরেই আরও বড় কোনো অফিসের বড় কোনো পদে দেখা যাবে তাকে।

হায় দ্যাশ!
তোমার কী হলো গো!
(সমাপ্ত)


ওয়াদুদ খানের     সাড়া জাগানো উপন্যাস  "সবই কি মিথ্যা ছিল"   ফ্রি পড়তে ডাউনলোড করুন   এখান থেকে (Click Here To Download The Novel)... 



     গল্পকার: ওয়াদুদ খান
            প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ
            সদরপুর সরকারি কলেজ
      ০১৭৮৫-৫৬২০৮০


Saturday, 25 November 2017

'পরোটা' খাও, দেশের 'বারোটা' বাজাও!

বোকা সোকা ছেলেটাকে আংকেল ডেকে কয়, 
"চাকুরির খোঁজে কেন জুতো-মেধা করো ক্ষয়?
এই দ্যাশ আজ শ্যাষ বুঝে গেছে পাগলেও
বাঘমামার কানে টান দিয়ে যায় ছাগলেও
গুরু খায় কিল, লাথি- গরু পায় পুজোটা!"
চুপচাপ কথা শোনে বোকা সোকা ছেলেটা। 

কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে ছেলে বলে, "আংকেল, 

মেধা ছাড়া চাকুরির জানা আছে কোনো খেল?" 
কত পড়ি, কত ঘুরি খুলে না তো মোর luck (লাক)।
চাকরির চিন্তায় চুল ঝরে হলো টাক।" 

চুন দিয়ে পান খেয়ে চাচা করে ঠোঁট লাল

"খাটি কিছু চলে না তো, চলে খালি পঁচা মাল
যদি থাকে ধৈর্য, যদি থাকে ইচ্ছা
শোনো তবে ও পাড়ার ফজলুর কিচ্ছা
টেনেটুনে মাস্টার্স করেছিল কমপ্লিট
তাতেই সে হয়েছিল মহা ফিট, মহা হিট!
এখন সে রোজ খায় মোগলাই-পরোটা,
লাউয়ের আগা খায়, খায় তার গোড়াটা 
যদিও বা বেজে গেছে স্বদেশের বারোটা।" 

"তারপর? কী গো হলো?" জিগায় ওই ছেলেটা।

"নেতা ধরে পাতি ঢেলে ঢুকেছিল কলেজে
ফজলুটা ডিজি হবে ছিল কার নলেজে?"
"ডিজি হলো! তাই নাকি? কীভাবে কি possible (পসিবল)?" 
ছেলেটার দুই চোখে দেখা মেলে নোনাজল।
"ঘুম থেকে ওঠে দেখে কলেজ ওর জাতীয় 
ফজলুরা হয়ে গেল ক্যাডারে আত্তীয়
তেল মেরে কাজ সারা ওদের কাছে easy (ইজি) গো
তাই ওরা শিক্ষার এডি, ডিডি, ডিজি গো।"


ওয়াদুদ খান
প্রভাষক, ইংরেজি
সদরপুর সরকারি কলেজ

ওয়াদুদ খানের সাড়া জাগানো উপন্যাস কষ্টকথা সাফল্যগাথা কিনতে চাইলে, অনলাইনে অর্ডার করুন এখানে (Click Here To Order Your Copy)


Wednesday, 27 September 2017

পাসের হার যেখানে ১৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ!


শিক্ষিত বেকার তৈরিই কি তবে এ শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা অনুষদের অধীন 'খ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ৩১ হাজার ৩৩৬ জন। ন্যূনতম নম্বর পেতে ব্যর্থ হওয়ায় অকৃতকার্য হয়েছে ২৬ হাজার ১৪৫ জন। (সূত্র: প্রথম আলো) এমন চিত্র শুধু এ বছর নয়, প্রায় প্রতিবছরই দেখা যাচ্ছে।

বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- বেশিরভাগ শিক্ষার্থী খারাপ করেছে বাধ্যতামূলক ইংরেজি অংশে। এমনকি এবার এইচএসসি পরীক্ষা '১৭-এ রেজাল্ট বিপর্যয়ের  পেছনেও দায়ী ওই ইংরেজি।

বাংলাদেশ থেকে সময়ের ধারাবাহিকতায় ইংরেজিভীতি দূর না হয়ে বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে প্রাইমারি স্কুল থেকেই। এইচএসসি লেভেলের এমন হাজারো শিক্ষার্থী রয়েছে যারা ইংরেজিতে একটি এপ্লিকেশন কিংবা ই-মেইল বানিয়ে লেখার সাহস পায় না।

ইংরেজি ভোক্যাবুল্যারি (vocabulary) কিংবা বাক্য গঠন (sentence building) তারা সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে পারেনি।

মজার ব্যাপার হলো- অনার্স সেকেন্ড ইয়ার ও ডিগ্রি থার্ড ইয়ারের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত বারোটি টেন্স ( Tense) বাংলায় চিনবার উপায়সহ আয়ত্ত করতে পারেনি।

বিষয়টি এমন না যে- অভিভাবক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ ইংরেজির ব্যাপারে উদাসীন। দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক অভিবাবক বছরব্যাপী গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। সারাবছর ব্যাচে কিংবা কোচিংয়ে ইংরেজি চর্চা করছে বাকি শিক্ষার্থীরা। তবুও রেজাল্ট ধ্বস থামছেই না।

তাহলে বিজ্ঞ শিক্ষকবৃন্দ ক্লাসে কিংবা ক্লাসের বাইরে কী শেখাচ্ছেন? শিক্ষার্থীরাই বা কী শিখছে?

কিছুকিছু শিক্ষাবিদ বলছেন- সঠিকভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হলে এসএসসি কিংবা এইচএসসিতে পাশের হার থাকতো সর্বোচ্চ ৪০ (চল্লিশ) শতাংশ।

ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কোনো কলেজে অনার্স কিংবা পাস কোর্সে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হলে তার জন্য ফার্স্ট ক্লাস মার্কস নিশ্চিত বলা যায়। অভিযোগ রয়েছে ঢালাওভাবে সেখানে ইনকোর্স ও ভাইভার নম্বর প্রদান করা হয়। অনার্স পাশ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা এতে ব্যাপকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। 

২০১৭ সালে ৩৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারির জন্য ২ হাজার ২৪টি পদের বিপরীতে আবেদন করেছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৬৮ জন । মানহীন উচ্চশিক্ষিত বেকার তৈরি করাই কি তবে এর উদ্দেশ্য?

"কোয়ালিটি এডুকেশন" শব্দদ্বয় একটি তামাশায় পরিণত হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন ভালো মানের শিক্ষক। ভালো মানের শিক্ষকের জন্য প্রয়োজন শিক্ষকতা পেশাকে আরও আকর্ষণীয় করা। কিন্তু সরকার শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বঞ্চিত করে রেখেছে। হতাশাগ্রস্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে কোয়ালিটি এডুকেশন আশা করা যায় না।

পুরো শিক্ষাব্যবস্থা এক কঠিন দুষ্টচক্রে আবদ্ধ। দিনভর নীতি কথা আওড়িয়ে এর পরিবর্তন করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার করুণ হালকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
এর পরিবর্তন কীভাবে হবে- সেটা নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

লেখা: ওয়াদুদ খান
প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ
সদরপুর সরকারি কলেজ, ফরিদপুর

Sunday, 24 September 2017

রাশেদের সবই কি আসলেই মিথ্যা ছিল?

এক সপ্তাহ হয়ে গেল প্রায়-
স্নান সারেনি রাশেদ। তিনদিন তিনরাত কেটে গেল প্যান্ট আর টি-শার্টটাও বদলানো হয়নি ওর। কবিতার মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছে- সেখানে আগের মতো আর ভালোলাগা নেই। হাতটা নিশপিশ করেছে অসংখ্যবার, কিন্তু মোবাইলের উপর থেকে ফিরিয়ে এনেছে। সামিহার সাথে কথোপকথনগুলো বারবার পড়েছে ও। “কেন এভাবে জড়াতে গেলাম? এখন কি ফিরে আসার আর কোনো পথ জানা আছে?”, মনে মনে বলল রাশেদ।

সামিহার প্রোফাইলে চোখ বুলালো ও। মুখটা দেখে মনে হলো পবিত্র। কোনো মিথ্যা সেখানে নেই। অদ্ভুত এক সরলতা মায়াবী মুখটায়। হার মানল রাশেদ। মেসেজ না দিয়ে থাকতে পারল না ও।

“আপনাকে এখন, মিস করছি ভীষণ...............” লিখে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে রাশেদ। না, কোনো উত্তর নেই। শেষমেশ লিখতে বাধ্য হলো, “সামিহা, তোমাকে এখন, রাশেদ মিস করছে ভীষণ..................”

আহ! কী শান্তি!
কী ভালোলাগা চারধারে!
কত রোমাঞ্চ জমা পৃথিবী জুড়ে!
রাশেদের মেসেজটা পেয়ে সামিহা যেন ফিরে পেল নিশ্বাস। সব বিশ্বাস। নাম না জানা এক ভালো লাগায় দুচোখ বেয়ে বৃষ্টি নামল সামিহার। কোনো ভূমিকা করল না ও। সরাসরি বলল, “রাশেদ, তুমি কেমন আছ? খাওয়া দাওয়া হয়েছে এই কয়দিন ঠিকঠাক মতো? তোমাকে একটু কষ্ট দিয়েছি বলে দুঃখিত। এতটুকু কষ্ট না দিলে তো তোমাকে আমি আমার কন্ট্রোলে আনতে পারতাম না।”

নিঃসঙ্গ মিথ্যুক রাশেদ 

সামিহার মেসেজ পেয়ে অবাক হয়ে গেল রাশেদ। মেয়েটা তো ভারি ইমোশনাল। রিপ্লাই দিলো ও-
- আজব! আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আমাদের মধ্যে একটা যৌক্তিক সীমারেখা থাকা দরকার।
- আপনি আবার আমাকে ‘আপনি’ করে বলছেন?
- সামিহা, তোমার কি হয়েছে বলো তো? ফ্রাংকলি বলো।
- আপনি বুঝেন না?
- আমি যেটা বুঝেছি- আমি চাই না সেটা সঠিক হোক।
- কী বুঝেছেন? বলেন।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাশেদ। কিছু কথা গুছিয়ে আনাও কষ্টকর। তবুও বলতে হয়-
- ইউ আর এডাল্ট মিস সামিহা। দ্যাটস হোয়াই, আইম আসকিং ইউ অ্যা কোয়েসচন ডিরেক্টলি। ক্যান আই আসক?
- ইয়্যাহ, ইউ ক্যান।
- ডু ইউ লাভ মি?
একটুও ভাবল না সামিহা। সরাসরি বলে দিলো, "ইয়েস আই ডু। আই ডু। আই রিয়েলি লাভ ইউ। লাভ ইউ এ লট।"
এতটুকু বলার পর হু হু করে উঠল সামিহার বুক। এত আবেগ কেন মানুষের থাকে? রাশেদ ভেবে পাচ্ছে না কী বলবে। মিথ্যার আকাশেও যে এত তারা জ্বলে তা ওর জানা ছিল না। জিজ্ঞেস করল ও-
- আর ইউ সিরিয়াস? আর ইউ রিয়েলি সিরিয়াস?
- ইয়্যাহ। আইম রিয়েলি সিরিয়াস। আমি জানি না, কবে কখন কীভাবে আপনার প্রেমে পড়ে গেছি।
- কিন্তু কেন? কেন এই ভুলটা করলেন? সামিহা, আমি তো ‘ভালোবাসা’ জনিসটাই বিশ্বাস করি না।
- হোয়াট? ‘ভালোবাসা’ বিশ্বাস করেন না?
- রিয়েলি, আই ডোন্ট বিলিভ ইন লাভ মেকিং। আই হেইট লাভ। আই জাস্ট হেইট লাভ।
- কেন বিশ্বাস করেন না?
- কারণ, ‘ভালোবাসা’ বলতে কিচ্ছু নেই পৃথিবীতে। সব ছলনা। আর মিথ্যার বেসাতি। কবিদের অলীক কল্পনা। কোনোদিন ‘ভালোবাসা’ ছিল না। এখনো নেই। ইভেন, দেয়ার ইজ নো লাভ বিটুইন ইউ অ্যান্ড মি। ইউ হ্যাভ বিন ইমোশনাল। দ্যাটস হোয়াই, ইউ থট ইউ লাভড মি। একচ্যুয়েলি, ইউ ডোন্ট লাভ মি।
- না, আমি আপনাকে ভালোবাসি।
- হাসালেন। আচ্ছা, আপনি কি আমাকে দেখেছেন?
- না। তবে কল্পনায় দেখেছি।
- প্রোবলেম তো ওখানেই। উই শুড বি রিয়্যালিস্টিক। বাস্তবতা বুঝতে হবে। কবিতা দিয়ে মনের ক্ষুধা মেটে, বাট রিয়েল লাইফ চলে না।
- তাহলে কি কবিতা মিথ্যা?
- ইয়েস মিস সামিহা। কবিতা মিথ্যা। কিন্তু এই মিথ্যার সৌন্দর্য অতুলনীয়। এই মিথ্যায় সচেতনভাবেই ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে অনেকেরই।
- কিন্তু কীভাবে এটা হতে পারে? কবিতার ভাষাগুলো এত ভালো লাগে, সেখানে মিথ্যা কীভাবে থাকে? আমার মাথাটা কাজ করছে না।
- আপনাকে বুঝাচ্ছি। এই কবিতাটা শুনেন-
“হাজার বছর ধরে আমি আমি পথ হাঁটিতেছি
পৃথিবীর পথে ,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে
মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি...............”
দেখুন কবিতাটা মিথ্যায় ভরা। একজন মানুষ কি হাজার বছর হাঁটতে পারবে কখনো?
আবার মহাদেব সাহার এই কবিতাংশটুকু দেখুন,
“এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না
একবার তোমাকে দেখতে পাবো
এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-
বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার হবো
ভরা দামোদর
কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো
ইংলিশ চ্যানেল;
তোমাকে একটিবার দেখতে পাবো
এটুকু ভরসা পেলে
অনায়াসে ডিঙাবো এই কারার প্রাচীর..................”
দেখেছেন, প্রত্যেকটা বাক্য মিথ্যা। বাস্তবতার সাথে কি এতটুকু মিল আছে এই কবিতায়?
- রাশেদ ভাইয়া, তাহলে আপনিই বলে দিন- কেন কবিতা ভালো লাগে? মিথ্যা জিনিসটা ভালো লাগবে কেন?
- কারণ, আমাদের অবচেতন মন ওটাই প্রত্যাশা করে। বনলতা জানে তাঁর জন্য জীবনানন্দ হাজার বছর হাঁটবে না, হাঁটতে পারবে না। কিন্তু হাঁটার ইচ্ছে যে প্রকাশ করেছে- এটাই বড়ো হয়ে ধরা দেয় প্রেমিকার চোখে।
- কিন্তু ভালোবাসা কি আসলেই নেই? সবই কি কেবল কল্পনা?
- হ্যা তাই। অন্তত আমার এটাই মনে হয়। ওকে সামিহা, আপনি স্টাডি করেন। পরে কথা বলি।
- আমাকে কি ‘তুমি’ করে বলবেন না? নাকি বলা বারণ?
হাসলো রাশেদ। উত্তরে বলল, “কেন বলা যাবে না? অবশ্যই বলা যাবে। তুমি ভালোবাসার দরজায় তালা মারো। চাবিটা ফেলে দাও অচেনা সাগরে। কী দরকার ফাও ফাও ভালোবাসার? আর কষ্ট পাওয়ার?”

রাশেদের ‘তুমি’ সম্বোধনে তবুও কি যেন কি আছে? সামিহার আকাশটা এখনো নীল নীল লাগে!

(উপন্যাস: সবই কি মিথ্যা ছিল?
কিস্তি- ১৫)

পিডিএফ ফাইলে প্রকাশিত সম্পূর্ণ উপন্যাসটি ডাউনলোড করে পড়তে-
ক্লিক করুন এখানে...

ওয়াদুদ খান
সদরপুর, ফরিদপুর
১৪ জানুয়ারি, ২০১৬

Saturday, 23 September 2017

কাকা, ভালো-মন্দে মিলেমিশে এই এলাকায় থাকা

সদরপুরে আছি- 
রাতের কথা বাদই দিলাম, দিনের বেলায় মাছি। 
হালকা বৃষ্টি হলে-
রাস্তাগুলো যায় গো ডুবে তাতেই হাটু জলে। 
ক্যামনে বলো বাঁচি-
চাচার থেকে এই এলাকায় বেশি বুঝেন চাচি।
হয়েছে মোর জ্বালা- 
বাপের দেখি  নাই গো অন্ন, পোলাও খাচ্ছে পোলা। 
কী আর বলবো ভাই-
সকাল-সন্ধা-মধ্যরাতে কারেন্ট যে আর নাই। 
মেজাজ থাকে হট-
বিদ্যুতের জন্য করলে মিছিল, চাকরি হবে নট। 
আহা, কত গরম-
গা বাঁচাতে খুললে কাপড়, লাগে না আর শরম। 
কারেন্ট ছাড়াই ডিজিটাল-
আমরা কি আর মানুষ আছি, হয়েছি সব গরুর পাল। 


সিদ্দিক ভাইয়ের সাথে আড্ডারত

(বি.দ্র. সুমনা লাইব্রেরিতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় গল্প করতে বসলে, সিদ্দিক ভাই বলেন, "স্যার এত কবিতা লিখেন কিন্তু সদরপুরের কারেন্ট নিয়ে কোনো কবিতা লিখেন না কেন?" আমি প্রতিদিনই বলি, "হ্যা, লিখব।" কিন্তু লেখা আর হয়ে ওঠে না। অবশেষে আজকে দোকানে বসেই লিখে ফেললাম। এটি একটি ফান পোয়েম। প্লিজ, কেউ সিরিয়াসলি নিবেন না।)

ওয়াদুদ খান
২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

Thursday, 21 September 2017

জনতার আগুন (যে আগুন জ্বললে নেভানো কঠিন)


চারদিকে হুশহীন ঘুষখোর অফিসার
পা-চাটা পাবলিক ডাকে তবুও "স্যার! স্যার!"
মুখে ওরা রাতদিন নীতিকথা আওড়ায়
চুপচাপ বসে ওরা সুদ-দুধ- সব খায়।
গরীবেরে চুষে খেয়ে, দেয় কিছু অন্ন
চারদিকে উঠে রব, "ধন্য, হে ধন্য!"

যতদিন জনতা নিরিবিলি ঘুমাবে
ততদিন ওরা সাধে দেশটাকে লুটাবে।
আয় আম জনতা- নে রে লাঠি, সুরকি
মরছি তো মরবোই, তবে আর ডর কী!
এইবার শেষবার জ্বলে উঠা আগুনে
ঘুষখোর, সুদখোর- পাঠাবো সব শ্মশানে।


ঘুষ দেয়া-নেয়ার প্রতীকী চিত্র



ওয়াদুদ খান
সদরপুর, ফরিদপুর
২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬

Friday, 15 September 2017

কুরবানিও ফ্যাশন এখন



কুরবানি আজ ত্যাগ বুঝায় না
বুঝায় তোলা সেলফি
ট্যাগ করা হয় বন্ধু-স্বজন
দ্যাখ রে গরু কিনছি।

কুরবানি আজ হইছে ফ্যাশন
ফেবুর লাগি স্ট্যাটাস
আমার গরু এত্ত বড়ো
খাচ্ছে ভুষি, খাচ্ছে ঘাস।

কুরবানি আজ লোক দেখানো
সমাজ জুড়ে কম্পিটিশন
তোমার গরু পিচ্চি এত-
আমার গরু মোটকু ভীষণ।

কুরবানি আজ ফ্রিজমুখী
গরীব-দুখীর অংশ নাই
বছর জুড়ে মাংস খাওয়া
নিয়্যত ছহীর বংশ নাই।

কুরবানি আজ কুরবানি নাই
হয়ে গেছে ট্র‍্যাডিশান
ঋণ করে তাই- কুরবানি চাই
রাখতে বংশের সম্মান!


ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত 

সদরপুর, ফরিদপুর
লেখার তারিখ: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ 

Wednesday, 13 September 2017

দহন (যে দীর্ঘশ্বাস থামেনি আজও!)

আমি ভুলেও ভাবিনি, স্বপ্নেও কল্পনা করিনি কোনোদিন- ওখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর একজোড়া চোখ, কিছু পাগল করা শব্দ- আর সেই চোখে, সেই শব্দে আমার জীবনের সর্বনাশ।
 
এখান থেকে শুরু
                                          

(পর্ব-১)

আজ ১০ ডিসেম্বর।
এই দিনটা এলেই বুকটা মোচড় দেয়। চোখজোড়া ভীষণ ঝাপসা হয়ে আসে। বড্ড দিশেহারা হয়ে যাই। বুকের একটা নাম না জানা জায়গায় চিনচিনে ব্যথা হয়। নিজেকে ধরে রাখতে পারি না কিছুতেই।

মানুষের জীবনে হাজারো দিন থাকে। তার মধ্যে দু’একটা দিন থাকে মনে রাখবার মতো। অথচ, কী ফালতু জীবন আমার! সবচেয়ে জঘন্য দিনটাই আমার মনে রাখবার দিন।
এই দিনটা এলেই- একটা মায়াবী মুখ ভেসে উঠে চোখের কোনায়, মনের পাতায়।
আর তিনটে শব্দ এক আশ্চর্য সুর হয়ে কানে বাজে-
“ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি।”

আজ সাতটি বছর শেষেও শব্দটা কানের কাছ থেকে সরাতে পারিনি। কত দিন হারালো রাতের অন্ধকারে। কত রাত ফুরালো দিনের আলোয়। ফুরালো কত মাস। কেটে গেল সাতটি বছর। বদলে গেল কতকিছু! শুধু আমিই বদলাতে পারলাম না।

বদলাতে কি চাইনি আমি? 
চেয়েছি। চেয়েছি ভালোবাসার নেশাকে সিগারেটের আগুনে পোড়াতে। তার সাদা ধোয়ায় মিশিয়ে দিতে। পারিনি।

এমনকি এই সাত বছরে কমপক্ষে চারবার ভালোবাসতে চেয়েছি অন্যকোনো নারীকে। তাও পারিনি। যতবার অন্যকোনো নারীকে ভালোবাসতে চেয়েছি, চেয়েছি নিষ্ঠুর অতীতকে ভুলে গিয়ে বর্তমানকে ভালোবাসতে- ততবারই বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি-
একটা মায়াবী মুখ আমার চোখের কোনায়, মনের পাতায়। আর শুনতে পেয়েছি পাখির কন্ঠস্বর, একটা আশ্চর্য সুর আর পাগল করে দেওয়া তিনটে শব্দ ...

আহ! এই ফালতু জীবনে কী সুন্দর দিন ছিল আমার! তখন ছিল ২০০৬ সাল। সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমার চেহারা মোটেই সুন্দর নয়। চেহারার তুলনায় ছাত্র হিসেবে আমি ছিলাম আরও নিম্নমানের। আমি পড়তাম টাঙ্গাইল এম.এম.আলী সরকারি কলেজে।

আমার বড় ভাই তখন কেবল সিলেট এমসি কলেজে জয়েন করেছেন। ভাইয়ার কলেজ দেখা, গ্রীষ্মকালীন অবকাশ কাটানো এবং ভাইয়ার কাছে প্রাইভেট ব্যাচে গিয়ে পড়া- এই উদ্দেশ্যে সিলেট যাওয়া।

কিন্তু আমি ভুলেও ভাবিনি, স্বপ্নেও কল্পনা করিনি কোনোদিন- ওখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর একজোড়া চোখ, কিছু পাগল করা শব্দ- আর সেই চোখে, সেই শব্দে আমার জীবনের সর্বনাশ।

কতকিছু ভুলে গেছি এই সাতটা বছরে।
অথচ, সেইসব সোনালী সকাল, উদাসী দুপুর, বিষন্ন বিকেলগুলো আজো ভুলিনি।
কেন এমন হয়? যা ভুলতে চাই- তাই কেন মনে জাগে বারবার?

প্রথম যেদিন ভাইয়ার প্রাইভেট ব্যাচে পড়তে যাই, সেদিন রুমে ঢুকবার সময় একটা মেয়ে দেখি। মেয়েটির নাম জানতে পারি দু’দিন পর।
তবে তাকে দেখেই একটা নাম দিয়ে ফেলি আমি। নাম দেই ‘মায়া’।
মনে হয়েছিলো- পৃথিবীর সব মায়া লুকিয়ে আছে ঐ মুখে, ঐ চোখে।
                   
“লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট” এটা যে শুধু কথার কথা নয়- আমার প্রথম যৌবনেই তা টের পেলাম।

ভালোবাসা কি জিনিস- আমি আজো তা জানি না। এখনো বুঝতে পারি না। সহস্র মানুষের মতো আমার নিজের মনেও এই প্রশ্নটা বারবার জাগে-
ভালোবাসা কাকে বলে?

তবে একটা বিস্ময়কর পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম আমার মাঝে। দেখলাম, চারপাশের সবকিছু কেমন জানি রঙিন রঙিন। আকাশটা দেখি আরো বেশি নীল।ঘাসগুলো দেখি আরো বেশি সবুজ। নাম না জানা এক ভালো লাগায় ভরে যাচ্ছে মন।

প্রাইভেটের একটা ঘন্টা মনে হতো এক সেকেন্ড পরেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর বাকিটা সময় কাটতেই চাইতো না। শুধু প্রাইভেট পড়ার সময় তাকে দেখে দেখার তৃষ্ণা মিটতো না আমার।

তাই, প্রাইভেট পড়ার আগে এবং পরে ওকে দেখবার জন্যে চায়ের দোকানে বসে থাকতাম আমি। ওকে দেখার মাঝে ছিলো এক অজানা সুখ, ভরে যেতো বুক। মাঝে মাঝে বিকেলবেলা ওকে দেখার জন্যে ওদের বাসার রাস্তার সামনে করতাম অকারণ হাঁটাহাঁটি।

রাত্রিবেলায় যখন পড়তে বসতাম- তখন মাথাটা ফাকা হয়ে আসতো। অবাক হয়ে দেখতাম, শুধু মন জুড়ে নয়, মাথার ডানকোনায় একটা ফাকা জায়গা তৈরি হয়েছে। সেখানেও ‘মায়া’র অবাধ বিচরণ। সেই যে মন, সেই যে মাথার ডান পাশটা ফাকা হয়ে গেল- সেটা ভরাট হলো না আজও।

বইয়ের পাতাগুলো মনে হতো ওর মুখাবয়ব। আমি তাকিয়ে থাকতাম অনিমেষ। কিছুই মাথায় ঢুকতো না আমার। যে আমি কবিতা কোনোদিন লেখিনি- সেই আমার মধ্যেও দেখতাম কবি কবি ভাব। কবিতা লিখতাম এরকম-

মায়া,
সারাক্ষনই দেখি তোর ছায়া।
তোকে খুব ভালোবাসি ...
সারাদিন সারানিশি ...

এই যে আমি ওকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনে চলেছি। সকাল, বিকাল, রাতে মারা যাচ্ছি। মাঝে মাঝে একটুও ঘুমাতে পারছি না। এসবের কিচ্ছু কি ও টের পেত? ও কি বুঝতে পারতো- একটা মানুষ ওকে দেখবে বলে টানা দুই ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছে ছাদে কিংবা চায়ের দোকানে। হয়তো বুঝতে পারতো কিংবা পারতো না। কিন্তু এর কিছুই ওকে জানাতে পারিনি আমি।

কতবার মনে হয়েছে- প্রচন্ড সাহসী হই। লজ্জার মাথা খেয়ে ওর সামনে দাড়াই। তারপর গলা ফাটিয়ে বলি-
“I love you, Maya.......”  
কিন্তু কেন জানি এক অজ্ঞাত কারণে বলতে পারিনি।


একটা মাস যে এত অল্প সময়- তা আগে কখনো টের পাইনি। মনে হলো, তিন ঘন্টায় ফুরিয়ে গেল পুরো একটা মাস। এই একটি মাস আগেও মনে হতো- এই শরীর, এই মন আমার। কিন্তু টাঙ্গাইল ফিরে যাবার ক্ষণে মনে হলো- আরে, কিছুই তো আমার নয়।

একটা অন্তসারশূন্য শরীর গাড়িতে চেপে শা-শা করে ছুটে চলল টাঙ্গাইলের দিকে। আর একটা মন পড়ে রইল সিলেটে। দেখলাম- চোখজোড়া ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথার ডানপাশটা আরো বেশি ফাকা হয়ে আসছে ...

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু যে ট্র্যাজিক গল্পের নায়ক আমি- তাতে এত তাড়াতাড়ি গল্পটা ফুরিয়ে গেলে যে মানায় না। তাই, গল্প এগিয়ে চলে জীবনের মতোই ...



(পর্ব-২)
                                             
তারপর ...? 
তারপর আমার দিনগুলো কাটছিল বিষন্নতায়। আর রাতগুলো নির্ঘুম। হঠাৎ মধ্যরাতে ওকে স্বপ্নে দেখে জেগে উঠতাম আমি। বুকটা হু-হু করে উঠতো। দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তো জল। সারারাত ছটফট করেও ঘুমাতে পারতাম না।
এত ভালোবাসতাম কেন ওকে?
এর কোনো মানে হয়?
আর এত কষ্টই বা কেন ভালোবাসাতে?

কলেজে অনেক সময় অন্যকোনো মেয়েকে ওর মতো হাসতে দেখলে ঘোর লেগে যেত আমার।

কতবার ইচ্ছে করেছে হরিণের মতো ছুটে যাই, পাখির মতো উড়ে যাই ওর কাছে। মাঝে মাঝে টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম সিলেটের দিকে। বুকটা ভরে যেতো শূন্যতায় ...

দিনগুলো তবুও কেটে যাচ্ছিল- শুকিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া মাঠের মতো। হঠাৎ সেই মাঠে একদিন ভালোবাসার বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশটা হয়ে গেল আবার রঙিন। ঘাসগুলো হয়ে গেল আবার সবুজ। জীবন খুজে পেল- বেঁচে থাকার মানে।

একদিন একটা ফোনকল আসে আমার মোবাইলে। রিসিভ করেই একটা নারীকন্ঠ শুনতে পাই। মুহূর্তের উত্তেজনায় ভাষাহীন হয়ে পড়ি আমি। যার সাথে শত ইচ্ছে সত্ত্বেও সরাসরি কথা বলতে পারিনি। আরে, এটা যে তারই ফোন ...

ও সেদিন যা বলেছিলো- তা গুছিয়ে বললে এরকম:-

“তোমার মতো স্টুপিড আমি জীবনেও দেখিনি। গাধা, ভালোবাসতে গেলে একটু সাহসও থাকা চাই। কতবার ভেবেছি- তুমি বোধহয় আমকে ‘ভালোবাসি’ বলবে। অথচ, বলতে পারোনি। তুমি ঐ শব্দটা না বললেও- আমি ঠিকই বুঝতে পারতাম- তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো।

কেমন হাধারাম তুমি- যাবার আগে তোমার ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে আমার নাম্বারটা কালেক্ট করতে পারতে। অথচ, তা করোনি। আমি মেয়ে হয়ে- অনেক কষ্ট করে- কৌশলে তোমার ভাইয়ার কাছ থেকে তোমার কন্ট্যাক্ট নাম্বার কালেক্ট করেছি। যাকে ভালোবাসি- তাকে যদি ভালোবাসার কথা নাই বলতে পারি- তাহলে ঐ ভালোবাসার কোনো মানে নেই আমার কাছে। এখন থেকে এই নাম্বারটা সেভ করে রাখবে। সুযোগ পেলেই কথা বলবো আমরা।”

কথা শেষ হবার পর দেখলাম-
মাথার ডানপাশটা আর ফাঁকা নেই।
মনের কোথাও কোনো শূন্যতা নেই।
আহ! ভালোবাসা এত ভালো ...

তারপর থেকে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা হয়ে গেল আমার।

গল্পটা শেষ হতে পারতো এখানেও ...

প্রায় পাঁচটি মাস- প্রতিদিন প্রায় পাঁচ ঘন্টা কথা বলেছি আমরা। এমনও রাত গেছে- সারারাত কথা বলেছি। মোবাইলের ব্যালেন্স ফুরিয়ে যেত, ব্যাটারি লো হয়ে যেত কিন্তু কথা ফুরাতো না।
কী কথাই না বলতাম আমরা!

হয়তো জীবনের সব কথাই ফুরিয়ে ফেলেছিলাম ঐ পাঁচ মাসে। সুখের মুহূর্তগুলো কেন জানি খুব অল্প হয়। শেষ হয়ে যায় দ্রুত।

অতঃপর জীবনের সেই জঘন্য দিনটি এল।
১০ ডিসেম্বর, ২০০৬।
খুব ফুর্তি নিয়ে সেদিন ঘুম থেকে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম- আজ সকালে কথা বলার শুরুতেই দশটা চুমু দেবো ওকে। ফোনটা সেদিন ওই করেছিল এক অজানা নাম্বার থেকে। কান্না জড়ানো কন্ঠে ও বলেছিল-

“দেখো, গতকাল রাতে কথা বলার সময় আম্মু আমাকে সরাসরি দেখে ফেলেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে শুনেছে আমার সব কথাও। এতদিন কথা বলেছি চুরি করে। ভেবেছি- আম্মু বোধহয় টের পায়নি।

মোবাইলটা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বলেছে- আমাকে আর মোবাইল ব্যবহার করতে দেবে না। তুমি চিন্তা করো না জান- আমি খুব তাড়াতাড়ি একটা মোবাইল কিনবো। আম্মু সেটা জানবে না। বান্ধবীরা তো নয়ই। শুধু তুমি জানবে। যতক্ষন কলেজে থাকবো- ততক্ষন লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার সাথে কথা বলবো। আর যে পর্যন্ত মোবাইল না কিনতে পারছি- প্রতি সপ্তাহে দোকান থেকে হলেও কমপক্ষে পাঁচ মিনিট  করে কথা বলবো। একটি কথা মনে রাখবে- আমি তোমারই আছি। তোমারই থাকবো সারাজনম।”

এইসব বলে মায়া যখন ফোনটা রাখতে যাবে- তখন আহত হৃদেয় ওকে বলেছিলাম-
“জানি না এটাই শেষ কথা হয়ে যাবে কিনা। ভবিষ্যত অনিশ্চত। তবে ফোনটা রাখবার আগে ঐ শব্দটা কমপক্ষে তিনবার বলো- যে শব্দটা শুনলে একই সাথে বাঁচতে ইচ্ছে করে, আবার মরতেও ইচ্ছে করে।”

তারপর মনে হয়- পৃথিবীর সব ভালোলাগা নিয়ে ও তিনবার বলেছিল-
“ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি।”


একাকীত্ব
কিন্তু সেই সাতটা দিন আর ফুরালো না। মনে হতো- কালকেই সাতটা দিন শেষ হোক।
অবশেষে সাতদিন গেল। সাত মাস পেরোলো। ফুরালো আজ সাতটি বছর। অথচ, আমার নাম্বারে ওর ফোন আর এল না।

এখনো মাঝে মাঝে আননোন কোনো নাম্বার থেকে কল আসলে আতকে উঠি। ভাবি- এই বুঝি ওর ফোন এল। কতকিছু ঘটে গেল এই নষ্ট ভ্রষ্ট পৃথিবীতে- শুধু ওর ফোনটাই আর এল না কোনোদিন। আমি ওর নাম্বারে চেষ্টা করেছি বহুবার। কিন্তু নাম্বারটা বন্ধই পেয়েছি। হয়তো বন্ধই থেকে যাবে অনন্তকাল ...

এই যে ওর জন্য এতটা দহন- প্রেমানলে পুড়ে পুড়ে নিরন্তর কাবাব হয়ে যাওয়া- এক নাম না জানা বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া- এর কোনো মানেই অনেকে খুঁজে পাবে না।


কিন্তু কি করবো- আমি যে আজও তাকে ভুলতে পারি না। জানি- হয়তো ওর সাথে আমার দেখা হবে না কোনোদিন। এও জানি- আমার এই দহনের কথা ও কখনো জানতেও পারবে না। তবুও-
এখনো এই দিনটা এলে- মনটা ভীষণ এলোমেলো হয়ে যায়।
একটা মায়াবী মুখ ভেসে উঠে চোখের কোনায়, মনের পাতায়। আর তিনটে শব্দ কানে এসে বাজে ...

অতঃপর দেখি-
চোখজোড়া ভীষণ ঝাপসা।
মন আর মাথার ডানপাশটা একদম ফাঁকা ...

ওয়াদুদ খান 
সদরপুর, ফরিদপুর
লেখার তারিখঃ ১০ ডিসেম্বর, ২০১৩

[ধৈর্য সহকারে এতবড়ো গল্প পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনাদের সাড়া পেলে এরকম আরো লেখা পোস্ট দেওয়ার ইচ্ছে আছে। ]

Monday, 4 September 2017

নোবেল চাই, দিতে হবে


"মানুষকে তাজা খাও", এই বাজে নীতি যার
অশান্তি লাগালে হয় দিল খুশি যার
চেনো নাকি তারে কেউ?
নারী-শিশু কেঁদে দিলে করে ওঠে ঘেউঘেউ।
তিন বেলা খায় সে যে মানুষের মাংস
শান্তিকে বেঁচে দিয়ে কিনে আনে ধ্বংস
দেখেছো কি তাঁরে কেউ?
শিশু-নারী কেঁদে দিলে করে ওঠে ঘেউঘেউ।
নোবেলটা পেয়ে গেছে রাক্ষসী সু-চিটা
তবে কেন বঞ্চিত কসাই আর মুচিটা?
কসাইটা গরু খালে, মানুষ তো খালে না
নোবেলটা চাই তাঁর, ইচ্ছেটা টলে না।

ছবিটি ফেসবুক থেকে সংগৃহিত  

ঋণ দিয়ে সুদ নিয়ে চুষে খেয়ে রক্ত
জন মহাজন হলো গরিবের ভক্ত
চেনো নাকি তাঁরে কেউ?
গরিবেরা কাছে গেলে করে ওঠে ঘেউঘেউ।
সুদ খেয়ে হাসি দেয় গরিবের বন্ধু
এক ফোঁটা জল ঢেলে ভেবে নেয় সিন্ধু।
দেখেছো কি তারে কেউ?
গরিবেরা কাছে গেলে করে ওঠে ঘেউঘেউ।
নোবেলটা পেয়ে গেছে দেশ সেরা সুদখোর
তবে কেন বঞ্চিত নিয়মিত গাঁজাখোর?
গাঁজা খেয়ে করেনি তো অন্যের অপকার
এবারের নোবেলটা এক দফা, দাবি তাঁর।

লেখা: ওয়াদুদ খান
০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
টাঙ্গাইল

Sunday, 3 September 2017

প্রাইভেট না পড়লে কি ভালো রেজাল্ট করা যায়?

(Private) প্রাইভেট পডাটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে সুজন। গা কাঁপানো শীত কিংবা শরীর ঝলসানো রোদ্দুর- কোনোকিছুই ওকে আটকাতে পারেনি। মাঝে মাঝে ঝুম বৃষ্টিতেও কাক ভেজা হয়ে চলে আসতো প্রাইভেটে।

কলেজ স্টুডেন্টস

ভেবেছিলাম, ইংরেজি কঠিন একটা সাবজেক্ট তাই প্রাইভেট পড়ছে সারা বছর। কিছুদিন আগে দেখলাম অর্থনীতিও প্রাইভেট পড়ছে ছেলেটা। কারণ জানতে চাইলে বলল, "স্যার, ইকনোমিকসে ম্যাথম্যাটিক্যাল কিছু ব্যাপার স্যাপার আছে। প্রাইভেট না পড়লে বোঝা মুশকিল।"

এর ঠিক কয়েকদিন পর দেখলাম ভূগোল প্রাইভেট পড়ছে সুজন। কারণ জানতে চাইলে বলল, "কারণ হলো, ভূগোলে কিছু চিত্র টিত্র আছে যা প্রাইভেট না পড়লে মাথায় ঢুকবে না।"

"আর কোন কোন সাবজেক্ট প্রাইভেট পড়ো?"

"আইসিটি। জানেন তো স্যার, আইসিটিতেও ম্যাথ আছে। প্রাইভেট না পড়লে কোনো উপায় নেই।"

"বাংলা কেন পড়ছো না? বাংলা গ্রামার তো অনেক কঠিন। তোমার মাথায় ঢুকবার কথা নয়।"

"জি স্যার। বাংলা প্রাইভেট পড়ার জন্য ব্যাচ রেডি করেছিলাম। স্যার হঠাৎ বদলী হয়ে যশোর এম এম কলেজে চলে গেলেন, তাই স্টার্ট করতে লেট হয়ে গেল। নেক্সট উইক থেকে নতুন এক টিচারর কাছে প্রাইভেট শুরু করছি আমরা।"

এই হলো সুজন। এ প্লাস পাওয়ার কথা স্বপ্নেও হয়তো কল্পনা করে না ছেলেটা। তবুও বছর জুড়ে অল সাবজেক্ট প্রাইভেট পড়ে।

সুজনদের দিকে তাকালে বোঝা যায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এবং কলেজের ক্লাসগুলোতে প্রচুর পড়ানো এবং বোঝানো হয়- সেটাও উপলব্ধি করা যায়।

ক্লাসে ইদানীং এত পড়ানো হয়, আর এত বোঝানো হয় যে- ছেলে মেয়েরা ক্লাসের পড়া কিছুই বোঝে না।

ওয়াদুদ খান
সদরপুর, ফরিদপুর  
লেখার তারিখ- ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ 

Friday, 1 September 2017

'ও' তে ওড়না চাই

বাঙালির কথা চলে
পেলে কোনো ইস্যু
কথা ছাড়া জানে না তো
এরা আর কিচ্ছু।

'ও' তে ওড়না চাই
টানাটানি এই নিয়ে
বিতর্কে সয়লাব
দেখো ফেসবুকে চেয়ে।



হিন্দু কি মুসলিম
বাঙালি দাবী যার
মার্জিত যে নারী
ওড়না চাই তার।

হাফ-প্যান্ট, গেঞ্জি
যে নারীর সজ্জা
"ওড়না চাই"- শুনতে
লাগে তার লজ্জা।

'আধুনিক' মানে তবে
ওড়নাটা লাগবে না?
বাঙালির রুচিবোধ
তবে কি আর থাকবে না?

[কবিতার প্রেক্ষাপট শিশুদের বইয়ে শেখানো হচ্ছে- ও তে ওড়না চাই। আর তাই নিয়ে চলছে ফেসবুকে বিতর্ক।]

লেখা: ওয়াদুদ খান
৪ জানুয়ারি, ২০১৭
সদরপুর, ফরিদপুর।

নারী (যাকে অনেকেই চেনে না কোনোদিন)


নারী মানে কারো মাতা,
নারী মানে কারো ভগ্নি।
তবুও এই নারীই জ্বালায়
পুরুষ হৃদয়ে প্রেমের অগ্নি।

নারী মানে মায়া,

নারী মানে অপার মমতা।
এই নারীই রাখে
পুরুষকে ক্ষয় করার ক্ষমতা। 


নারী মানে স্নেহ,
নারী মানে অগাধ বিশ্বাস।
এই নারীই হয় ছলনাময়ী,
পুরুষের করে সর্বনাশ।

নারী মানে প্রেরণা,

নারী মানে এগিয়ে যাবার সিড়ি।
এই নারীর প্রেমানলে পুড়ে,
অনেক পুরুষ টানে গাজা, বিড়ি।

নারী হলো প্রিয়া,

নারী হলো প্রিয়া থেকে শেষে বউ।
পুরুষ হৃদয়ে নারীই তোলে
পানি ছাড়া প্রেম সাগরের ঢেউ।

নারী হলো ছন্দ,

নারী হলো ভাষা,
নারী হলো
কবির কবিতাখানি।
নারী হলো দুর্গা,
নারী হলো লক্ষ্মী।
এই নারীই মারে ছোবল,
বিষাক্ত কালনাগিনী।

লেখা: ওয়াদুদ খান
৩১ আগস্ট, ২০১৪


Tuesday, 29 August 2017

নই তো কবি

নই তো লেখক, তাই বলে কি
মনের কথা লিখবো না?
আমার মনের দহন ব্যথা
ইচ্ছে মতো আঁকবো না?


নই তো কবি, তাই বলে কি
আসবে না মোর ছন্দ?
সরবে না কি তৈরি হওয়া
মনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব?

নই তো ধনী, তাই বলে কি
স্বপ্ন আমার থাকবে না?
জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি
পাবো কেবল সান্ত্বনা?

আতেল আমি, তবুও লিখি
বেতাল মনের কবিতা।
নিজের সাধে নিজেই উড়ি
ভাবুক লোকে যা খুশি তা।

ওয়াদুদ খান 
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
সদরপুর, ফরিদপুর।

অকারণ মরণ (এক মেধাবী ছাত্রের ঝরে যাওয়ার কাহিনি)

আছি
মৃত্যুর কাছাকাছি
যাবো চলে
সব ফেলে
ঐ দূর পরপারে
কেউ কি খুঁজবে আমায়
রাতের অন্ধকারে? 

এখান থেকে শুরু


পর্ব-১


অবশেষে মরণ হলো আমার।
পৃথিবীতে কেউ অমর নয়। তাই, আমি যে মরলাম- এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এইভাবে এত তাড়াতাড়ি মরতে চাইনি আমি।

আমি যখন পৃথিবীতে আসি তখন কেউ খুশি হয়েছিল এমনটা শুনিনি। বরং রাগে, অভিমানে সেদিন বাবা নাকি বাড়িতেই আসেনি। কারণ, আমাদের ঐ নিম্নবিত্ত পরিবারে আমার আগে আরও চারজন জায়গা করে নিয়েছিল। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’- এমন সংসারে আমার জন্মগ্রহনটা শুধু সংখা বৃদ্ধিই ঘটিয়েছিল।

যার আগমনে যেখানে এই পৃথিবীর কারও কোনো আনন্দ নেই, তার চির প্রস্থানে পৃথিবীর  কারও এতটুকু দুঃখ থাকবে না- সেটা খুব ভালো করেই জানতাম আমি। বাঁচার নেশা ছিল আমার মদের নেশার চাইতেও বেশি।

প্রায়ই ভাবতাম -
কী হবে মরে গিয়ে?
কে ছাড়বে দু’ফোটা জল আমার জন্যে?
কে ছাড়বে একটু দীর্ঘশ্বাস?
যার বেঁচে থাকায় এই পৃথিবীর কিছু যায় না, আসে না। তার মরণেও এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর কিছু যাবে না, আসবে না- এটাইতো স্বাভাবিক।

কী ফালতু জীবন আমার!
বেঁচে থাকায় কোনো আনন্দ নেই।
মরণেও যেন এতটুকু স্বান্ত্বনা নেই।
বহতা নদীর মতো অকারণ ছুটে চলা।
আর সাগরের অন্তহীন জলরাশির সাথে মিশে নিজেকে হারিয়ে ফেলা।

তবুও- জীবনটা কেন জানি মনে হতো ভীষণ সুন্দর। রোমাঞ্চকর। তাই, মরে গিয়ে- হেরে যেতে চাইনি আমি। হয়তো এই সুতীব্র বাঁচার নেশাটাই- মৃত্যুকে আকর্ষণ করেছিল বেশি।

আমি সুকান্ত নই। নই শেলী, কীটস কিংবা বায়রন। বয়স তাই তেইশ পেরিয়ে গেলেও, এমন কিছু করতে পারিনি- যার জন্য মরণের পরেও কেউ মনে রাখবে আমায়।

ছোটোবেলা থেকেই কবিতা লেখার খুব নেশা ছিল আমার। ভেবেছিলাম- বড়োমাপের একজন কবি হবো আমি। কবিতাও লিখেছিলাম অনেকগুলো। একটি কবিতা আজও মনে পড়ে। তবে কবিতার নামটা মনে নেই।

আছি
মৃত্যুর কাছাকাছি
যাবো চলে
সব ফেলে
ঐ দূর পরপারে
কেউ কি খুঁজবে আমায়
রাতের অন্ধকারে?

মাগো তুমি হীনা

কেউ মনে রাখবে কিনা
জানি না।

আজ নয় কাল

হয়ে যাবো একদিন স্মৃতির আড়াল
সাগরের এক ফোঁটা পানির মতো
ফুরিয়ে যাবো
হারিয়ে যাবো
কেউ জানবে না।
কেউ জানবে না।

এমন ছাইপাশ আরও অজস্র কবিতা।
কিন্তু এক সন্ধ্যায়-
এক মেয়ের সাথে অভিমান করে সমস্ত কবিতা এক পুকুরে ফেলে দিয়েছিলাম। কবিতার খাতার মতো আমার ভিতরকার কবি মানুষটাও সেদিন পুকুরে ডুবে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।

তারপর আর কখনো চাঁদের দিকে তাকিয়ে কোনো মুখ দেখতে পাই নি আমি। মেঘের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাইনি কোনো ঘন কালো চুল। ফুলের দিকে তাকিয়ে মনে হয়নি- কারো মন ফুলের মতো সুন্দর।

তবুও জীবন এগিয়ে চলছিল। অর্থহীন এক পরিনামের দিকে। দেখতে দেখতে অনার্স তৃ্তীয় বর্ষে পা রাখলাম আমি।


পর্ব-২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম আমি। মরণ দেখে ভীষণ ভীতু এই আমি ঢাকা শহরের মূল রাস্তায় বের হতাম কম। হরতাল কিংবা হরতালের আগের দিন- সারাটাদিন রুমে বসে বই পড়তাম। কারণ, প্রতিটা হরতালে অনেক নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছিল।

সেদিনের সকালটা ছিল চমৎকার। রোদ্রকরোজ্জ্বল। মনটাও ছিল ফুরফুরে। পকেটে ছিল সদ্যপ্রাপ্ত টিউশন-ফির হাজার পাঁচেক টাকা। একটা রিকশা ভাড়া করে মতিঝিল যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কেন জানি ঢাকা শহরটা খুব সুন্দর লাগছিল। এই নোংরা শহরটাকে এত ভালো আগে কখনো লাগেনি তো!

মতিঝিল শাপলা চত্বরে নেমেই থমকে দাঁড়াই। একি শুরু হয়েছে এখানে! একদিকে জামাত শিবিরের জঙ্গী মিছিল ধেয়ে আসছে। তাদের সবার হাতে লাঠি আর ইটের টুকরো। অন্যদিকে তাকিয়ে দেখি শত শত পুলিশ।

আজ তো হরতাল নয়। তাহলে হঠাৎ কী শুরু হলো এখানে! দেখি শিবিরের লোকজন ‘নারায়ে তাকবীর- আল্লাহু আকবার’ বলে নির্বিচারে গাড়ি ভাঙছে। পোড়াচ্ছে। ছুড়ে মারছে ইটের টুকরো। আর পুলিশ বাহিনি ছুড়ছে কাঁদানে গ্যাস, জল কামান আর রাবার বুলেট। আমি ৭১ দেখিনি। দেখেছি ২০১৩। মনে হচ্ছিল আরেক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে এখানে।

অকারণ মরণ


আমি ঢাকা শহরের অলি গলি তেমন চিনি না। কোথায় পালাবো বুঝতে পারার আগেই দেখি- আমার কপালের এক কোণা বেয়ে রক্ত ঝরছে। দু’হাত দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। তখন আর একটা শব্দ এল কানে.........

দেখলাম- বুক বরাবর কি যেন একটা ঢুকে গেলো। হঠাৎই ঘোর লেগে গেল চোখে। দেখি- বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর আমার দু’চোখের সামনে- চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাওয়া আমার বাবার মুখখানা.........

তারপর যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম- ততক্ষনে মরণ হয়ে গেছে আমার। প্রায় আট ঘন্টা জীবনের সাথে যুদ্ধ করে গভীর রাতে হেরে যাই আমি। তবে মরে গিয়ে দেখলাম- আমি মানুষটা অতো কম দামী নই। পঁচিশ হাজার টাকার একটা চেক পেয়েছে আমার পরিবার। খারাপ কি আমার জীবনের দাম?

যে আমি এদেশের রাজনীতিকে ‘গু’ এর চাইতেও বেশি ঘৃ্না করতাম- মরণের পরে দেখলাম- সেই আমি নাকি শিবিরের একজন ত্যাগী কর্মী। আমি নাকি শহিদ হয়ে গেছি।

আবার দেখলাম- ছাত্রলীগ বলছে, "আমি নাকি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমি নাকি মুজিব সেনা।"
আমার বিধবা মায়ের সারা জীবনের কষ্ট। তার শখের সোনার হার বিক্রি করে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা। আর কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করে শেয়াল ডাকা রাত্তির পর্যন্ত- নিরন্তর ক্লাশ, টিউশন কিংবা  বই পড়ায় মগ্ন থাকা- সবই ব্যর্থ হয়ে গেল কয়েকটি ইটের টুকরো আর একটা বুলেটের কাছে। মুহূর্তেই।

একটা মোবাইল নাম্বার বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে। চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। এরকম বন্ধ হচ্ছে প্রতিদিন। তাই পৃথিবীর কিছু এল না। কিছু গেলও না।
ভেবেছিলাম- মরণের পর কারো মনের পাতায় কিংবা কারো লেখার খাতায় ঠাঁই হবে না আমার। অবাক হয়ে দেখলাম- পরের দিন বেশ কয়েকটি পত্রিকায় ছোটো করে হলেও জায়গা পেয়েছি আমি। কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম ছিল এমন-

(১) "শাহাদাত বরণ করলেন আরেক শিবির নেতা”- দৈনিক চার দিগন্ত
(২) “শিবিরের হামলায় প্রাণ গেল আরেক মুজিব সেনার”- দৈনিক মানুষকন্ঠ
(৩) “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র খুন”- দৈনিক ভোরের আলো

তারপরের দিন- খবরের পাতা ভরে গেল অন্যসব নতুন খবরে।
আর আমি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলাম মহাশূন্যে। ধোঁয়ার মতো...............

লেখা: ওয়াদুদ খান
কবি ও কথাশিল্পী

[লেখার প্রেক্ষাপট: ২০১৩ সালের (সমকালীন) রাজনীতি
লেখার তারিখ: ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৩]

ক্ষয় (করুণ প্রেম ও অবক্ষয়ের কাহিনি)



তোর মতো আমারও একটা মন ছিল। কিন্তু সেই মনের দরজায় মস্ত এক তালা ঝুলিয়েছিলাম। কেননা, কারও ভালোবাসা পাবার যোগ্য আমি ছিলাম না। এই যান্ত্রিক পৃথিবীতে ভালোবাসা পেতে কিংবা দিতে বুক বোঝাই ভালোবাসা নয়, লাগে পকেট বোঝাই টাকা। কিন্তু নিজের এই অক্ষমতা, অযোগ্যতা কিংবা দারিদ্রতা কারো কাছে প্রকাশ করতে চাইতাম না আমি। তাই কৌশলে শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। সেটাই বোধহয় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার জীবনে।

এখান থেকে শুরু

পর্ব-১

(এই গল্পটা যতবার পড়ি- ততবারই চোখ জলে ভিজে যায়। এটি একটি ট্রাজিক প্রেম ও অবক্ষয়ের কাহিনি)

আমি ইমরান।
আমার বন্ধু রাজিব। ও দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি চটপটে। ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হবার পর। আমাদের কলেজের বাংলা স্যার ছিলেন খুবই আমোদে। মাঝে মাঝেই ক্লাশে হাসির কবিতা আবৃত্তি করতেন উনি। ছাত্রছাত্রীদেরকেও উৎসাহিত করতেন কবিতা লিখতে। বাংলা স্যারের ক্লাশে রাজিব নিজের লেখা একটা কবিতা পড়ে শোনালো-

এই কলেজে পড়ি আমি
আমি পঁচা ছাত্র
লেখাপড়া করি না
বই কিনেছি মাত্র।

স্যাররা আমায় গাধা বলে
আমি তাতে খুশি
স্যাররা যখন গরু বলে
তখন তাদের দুষি।

বলি, ‘গাধা সে তো ভালোই বড়ো
বুদ্ধি আছে কিছু
গরু সে তো মূর্খ বড়ো
বুঝে না তো কিছু।
আমি স্যার বুঝি কিছু’,
শুনে স্যার হাসে।
বলে, ‘তুই বুঝস
ঘোড়ার ডিম জলে ভাসে।’

আমি বলি, ‘না, না স্যার,
ডিম পাড়ে না তো ঘোড়া।’
স্যার বলে, ‘বুঝস ভালোই
পারস না ক্যান পড়া?’

রাজিবের এই হাস্যরসে ভরা কবিতা শুনে ওকে ভীষণ ভালো লেগে যায় আমার। তারপর খুব কৌশলে ওর সাথে বন্ধুত্ব জমিয়ে ফেলি।

কিছু কিছু বন্ধু হয়- যাদের সাথে মিশে মানুষ নষ্ট হয়। আবার কিছু কিছু বন্ধু আছে যাদের সাথে মিশে ভালো হয়ে যায় অনেক ছেলে। রাজিব ছিল এমন একটা ছেলে যার প্রত্যেকটা দিকই ভালো লাগতো আমার। এবং ভালো হবার অনুপ্রেরণা পেতাম।

ওকে কখনোই প্রথম বেঞ্চে বসতে দেখিনি আমি। ও বসতো সবার পেছনে। এতটাই পেছনে বসতো যাতে কোনো টিচারের কথা ওর কানে না যায়। ক্লাশের একঘেয়ে পড়াশোনাকে বড্ড ঘৃ্না করতো ও। ক্লাশ মিস করায় ও ছিল সবার সেরা। ওর কথা হলো-

প্রতিদিন একই নাটক।
শিক্ষকের হাতে থাকবে চক।
মুখে থাকবে বকবক।
অকারণেই স্যারের পা করবে ঠকঠক।
আর ছাত্রছাত্রীদের বুকটা করবে ধকধক।

ওর এইসব ছন্দ শুনে আমরা হেসে উঠতাম কক কক করে।

ওর এই এলোমেলো স্বভাবের কারণেই হয়তো ওকে ভালো লাগতো বেশি। তবে মজার ব্যাপার হলো- কলেজের প্রতিটা পরীক্ষায় প্রথম হতো ও। এই ছেলেটা এত ভালো রেজাল্ট কীভাবে করছে- সেটা ছিল সবার কাছেই একটা বিস্ময়। কারণ, ওর হাতে গল্পের বই ছাড়া অন্য কোনো পড়ার বই কেউ কখনো দেখেনি।

ওর মাথায় সব সময় দুষ্ট বুদ্ধি ভর করতো। প্রায় সকল টিচারকে নিয়েই ছন্দ বানাতো ও।

এই তো কিছু দিন আগে আমাদের কলেজে কাউসার নামে এক স্যার এলেন। স্যার দেখতে খুবই সুন্দর। লম্বাও যথেষ্ট। সমস্যা হলো উনার মাথার সামনের দিকটায় চুল একেবারেই নেই। এই স্যারের আরেকটি সমস্যা ছিল- কোনো ছাত্রী উনার সামনে গিয়ে দাড়ালেই- উনি প্রথমে উনার চশমাটা চোখ থেকে নামাবেন। তারপর রুমাল দিয়ে চশমার কাঁচটা পরিষ্কার করবেন কয়েকবার। শেষমেষ চশমাটা আবার নাকের ডগায় বসাবেন। তখন এটা বুঝা কঠিন হয়ে যায়- উনি চশমার ভেতর দিয়েই দেখছেন নাকি খালি চোখে দেখছেন।

রাজিব করলো কি এই স্যারকে নিয়েও একটা কবিতা বানিয়ে ফেললো-

কলেজে এলেন নতুন স্যার
নাম তার Cow Sir (কাউসার)
ছাত্রীরা সামনে এলেই উনি যান দমে
উনার চশমার পাওয়ার যায় কমে।
উনি তাই কাঁচ ঘষেন বারবার
নাম তার Cow Sir (কাউসার)
চেহারাটা স্যারের কিন্তু একের
সবই তার ঠিকঠাক
শুধু ভুল করে চুল খসে
মাথায় পড়েছে টাক...

ওর এই কবিতা শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতাম আমরা। তবে যে ব্যাপারটা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করতো সেটা হলো- ও কখনো মেয়েদের সাথে মিশতো না। মেয়েদের থেকে চারশত গজ দূরে থাকার চেষ্টা করতো ও। মনে হতো- এ ব্যাপারে একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হয়েছে। এতটা মেয়ে-বিমুখ ছেলে আমি আর দেখিনি।

এটা বোধহয় চিরন্তন সত্যি একটা ব্যাপার- কলেজে যত মেয়েই থাকুক- দুই একজন মেয়ে থাকবে অপরুপ দেখতে। তাদের রুপের আগুনে ঝাপ দিয়ে ছাই হতে চাইবে অনেক ছেলেই। তেমন একটা মেয়ে ছিল- রিয়া তার নাম। 

পর্ব-২

আমি তো মাঝে মাঝেই মেয়েটার দিকে হা-করে তাকিয়ে থাকতাম। এতটা সময় ধরে হা-করে তাকিয়ে থাকতাম যে একবার একটা মাছি ঢুকে গিয়েছিল মুখের ভেতর। অথচ, রাজিবকে দেখেছি একেবারেই নির্বিকার। মনের ভুলেও তাকাতো না রিয়ার দিকে। রাজিবকে দেখে খুব হিংসা লাগতো আমার। আমি কেন ওর মতো হতে পারি না?

আমি রিয়াকে প্রেমের একটা চিঠি দেবো ভাবছিলাম। সমস্যা হলো আমি ভালো ছাত্র নই। কোনো কিছুই গুছিয়ে লিখতে পারি না। প্রেমের অফার সংক্রান্ত চিঠির শুরুটা কেমন হবে তাই গবেষণা করলাম দুই রাত।

- পত্রের শুরুতে আমার সালাম নিবেন।
- পত্রের শুরুতে আমার ভালোবাসা নিবেন।
- পত্রের শুরুতে জানাই শুভেচ্ছা।
- পত্রের শুরুতে জানাই ইত্যাদি ইত্যাদি .......

কোনোভাবেই আর পেরে উঠছিলাম না। তাই বাধ্য হয়ে ছুটে যাই রাজিবের কাছে। বলি, “দোস্ত, একটা চিঠি লিখে দে না? প্রেমের অফার রিলেটেড। কিছুতেই চিঠিটা গুছিয়ে আনতে পারছি না।”
- “কার কাছে দিবি এই চিঠি?”
- “রিয়াকে দেবো। জানিস তো ওকে দেখার পর থেকে আমার মাথা আর ঠিক নেই। জানি, ও হয়তো আমাকে ভালোবাসবে না। না বাসুক। নিজের ফিলিংসটা জানিয়ে রাখি। মরা শামুকে পা কাটতেও তো পারে, তাই না?”

একথা শোনার পরে ও আমকে একটা চিঠি লিখে দিলো এরকম-

রিয়া,

আমার ফ্রেন্ড ইমরান তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। সে সারাক্ষন তোমার দিকে হা-করে তাকিয়ে থাকে। হা-করে তাকিয়ে থাকা হচ্ছে ভালোবাসার ‘হাহিপ্রকাশ’‘হাহিপ্রকাশ’ হচ্ছে বহিপ্রকাশের চেয়ে বেশি কিছু। তুমি যদি আমার বন্ধুটাকে ভালোবাসো- সেটা ভালো। আর যদি ভালো না বাসো- সেটা আরো ভালো।


ইতি

রাজিব

চিঠিটার উত্তর রিয়া আমাকে দেয়নি। দিয়েছিল রাজিবকে। সেই চিঠিটা রাজিব আমাকে পড়তে দিয়েছিল। যাতে লেখা ছিল-

রাজিব,

তুমি ভাবলে কি করে ইমরানের মতো গাধা টাইপের একটা ছেলেকে ভালোবাসবো আমি। ওর চেহারাটা সুন্দর। মনটাও হয়তো সুন্দর। কিন্তু ও তোমার মতো ইন্টিলিজেন্ট নয়। তবে আমি খুব লাকি যে স্টুপিডটা তোমাকে দিয়ে চিঠিটা লিখিয়েছে। তুমি যে আসলেই অসাধারণ ব্রিলিয়ান্ট তার প্রমান ঐ ‘হাহিপ্রকাশ’ শব্দটা।


চিঠি যখন লিখতেই বসেছি তখন একটা সত্য স্বীকার করেই শেষ করবো। একথা মোটেই অসত্য নয় যে, অনেক ছেলেই আমার পেছনে ঘুরে। তবে তাদের কাউকেই আমার পছন্দ নয়। আমার ভালো লাগে তোমাকে। তোমার বুদ্ধিমত্তা, তোমার রেজাল্ট এবং দাড়ি শোভিত চাঁদের মতো মুখ- সবই আমাকে তীব্র আকর্ষণ করে।


তুমি আমাকে ভালোবাসো বা না বাসো দয়াকরে কখনো দাড়ি কাটবে না। দাড়ি কাটলে তোমাকে এত সুন্দর লাগবে না দেখতে। দাড়িওয়ালা ছেলে আমার আজন্ম অপছন্দের। তবে তোমাকে দেখার পর ধারনা পাল্টে গেল। কল্পনাতেও ছিল না দাড়িওয়ালা মানুষ এত সুন্দর দেখতে লাগতে পারে।


আই লাভ ইউ রাজিব।


ইতি

রিয়া

চিঠিটা পড়ে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। রাজিবের দিকে তাকিয়ে থাকি অনিমেষ। সত্যিই তো দাড়ি শোভিত রাজিবের মুখখানা চাঁদের চেয়েও বেশি সুন্দর। ভেবে দেখলাম- আমি যদি কোনো মেয়ে হতাম- অবশ্যই রাজিবকে ভালোবাসতাম। তাই রিয়াকে কোনো দোষ দিলাম না। মনটাও খারাপ করলাম না। বরং ভাবছিলাম- আজ থেকে আমিও দাড়ি রাখা শুরু করবো। প্রেমের ক্ষেত্রে দাড়ি কোনো বাধা নয়।

রাজিব কিন্তু রিয়ার ডাকে সাড়া দেয়নি। ঐ চিঠির উত্তরও সে দেয়নি কোনোদিন।

ভালোবাসাহীন এক অদ্ভুত জগতে রাজিবের সাথে বসবাসের চেষ্টা করলাম আমিও। দাড়িও রাখা শুরু করলাম। পড়া ধরলাম গল্পের বই। দেখলাম সময় কেটে যাচ্ছে। সময় কেটে যায়। সময়ের নিয়মই এমন।



করুণ কাহিনি

ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে আমরা দু’জনেই টাঙ্গাইল সা’দত কলেজে ভর্তি হই। ও অবশ্য জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটিতে ফিলোসফিতে চান্স পেয়েছিল। ওর মনমতো সাবজেক্ট না পাওয়াতে, ভর্তি হয়নি ওখানে। আমি মনে মনে এমনটাই চেয়েছি যাতে ও অন্য কোথাও ভর্তি না হয়। দু’জনেই পড়া শুরু করলাম ইংলিশ লিটারেচার। ঢুকে গেলাম সাহিত্যের অনন্য এক জগতে।

সেকেন্ড ইয়ারে উঠবার পর নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। আমাদের একটা সাবজেক্ট ছিল যার নাম ‘রোম্যান্টক লিটারেচার’। শেলী, কীটস, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ- ওদের কবিতা পড়ে এক অদ্ভুত রোম্যান্টকতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো মন। দেখলাম মনের দরজায় আর তালা মেরে রাখা যাচ্ছে না। চোখজোড়া আর কোনো বাধা মানছে না। প্রেমে পড়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার আদর্শ ছিল রাজিব। ওর হার না মানা স্বভাব তখনো ছিল।

ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল রাজিব। ওকে বন্ধু কিংবা প্রেমিক হিসেবে চেষ্টা করতো অনেক মেয়েই। কিন্তু পারেনি। ওর কথা হলো- জীবনে ভালোবাসা যায় দু’টি মাত্র জিনিসকে- সেটা হলো- ‘বই এবং বউ’- এছাড়া আর কাউকে নয়।

পুরো কলেজ ক্যাম্পাসটা যখন ভালোবাসার স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল- তখন দেখলাম, ও একটা কবিতা টানিয়ে রেখেছে ওর পড়ার টেবিলের সামনের দেয়ালে। কবিতাটা এমন-

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে
ভালোবাসার সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দেই।
ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেই-
শত শত প্রেমিকের রক্তে গড়া
ভালোবাসার টুইন টাওয়ার।

তারপর হবো ইতিহাস।

হবো ইতিহাস।

ভালোবাসার উপরে ওর এতো ক্ষোভ কেন তা বুঝতে পারতাম না আমি। ওকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে শুধু বলতো-

পৃথিবীতে আসলেই
প্রেম বলে কিছু নেই।
আজ যে মোর
কাল সে তোর।
আজ যে কাছে
কাল সে দূর......

ফোর্থ ইয়ারে পা দেওয়ার পর ওর মাঝে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। এই পরিবর্তন আমি কল্পনাতেও করার সাহস পাইনি .....

পর্ব-৩


আমি থাকতাম উত্তরা হলে। আর ও থাকতো সিএম হলে। ওর সাথে দেখা হতো প্রায় প্রতিদিন। মাঝখানে সপ্তাহ খানিকের মতো ওর সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো না। ফোন করেও পাচ্ছিলাম না ওকে।

ওর সাথে দেখা হলো সেদিন। দেখি দাড়িগুলো অনেক খাটো করে ফেলেছে ও। ওর চুলগুলো ছিল কাজী নজরুলের মতো বাবরী দোলানো। সেই চুলও আর সেরকম নেই। অনেক খাটো করে ফেলেছে। ওকে দেখে আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল- ভুল দেখছি আমি। আমি ওকে বললাম, “রাজিব, আমি তো ভাবতেই পারছি না- তুই এতোটা বদলে গেছিস এই ক’টা দিনে। হঠাৎ বাউন্ডুলে ভাবটা ছাড়ার কারণ কি? তবে এখনো তোকে দেখতে কিন্তু চমৎকারই লাগছে।”

রাজিব বলল, “আমি হেরে গেছি ইমরান। আজ এই চব্বিশটা বসন্ত শেষে এসে বুঝলাম- ভালোবাসার শক্তি আদি অন্তহীন।”
আমার ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল অপার বিস্ময়ে।
- “মানে?”
- “মানে আমি প্রেমে পড়ে গেছি ইমরান।”
- “কার প্রেমে?”
-  “রিয়ার।”

দেখি, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাচ্ছে দ্রুত। সামনে দেখি সেই সোনালি সময়। রিয়া। যাকে প্রথম দেখে- সেই প্রথম যৌবনে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। যাকে পটানোর চেষ্টা করেছিলাম বোকার মতো। সেই মেয়েটি এখনো ভুলেনি রাজিবকে?
এও কি হয়?
এটা কি বিশ্বাস করা যায়?

বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম- রিয়া যদি সত্যিই রাজিবকে এখনো ভালোবেসে থাকে তাহলে এই ভালোবাসা মেকি নয়। যেখানে একটি চিঠি লেখার যে সময়- সেই সময়ের ব্যাবধানে নারীর হৃদয় তিনবার বদলায়- সেখানে রিয়া প্রায় ছয়টি বছর ধরে ভালোবেসে চলেছে রাজিবকে।

ভালোবাসা বলতে একটা জিনিস এখনো তাহলে আছে?
হঠাৎ-ই ভীষন মিথ্যে মনে হলো রাজিবেরই লেখা একটা কবিতার শেষাংশ-

আকাশের রঙের আগেই
নারীর মন বদলয়ায়।
এই আলতু ফালতু যুগে
ভালোবাসে কোন শালায়?

তারপরের দিনগুলো রাজিবের জন্য হয়ে গেল রোমাঞ্চ জাগানিয়া। আমার প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে গেল বিবর্ণ। হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে- তাকিয়ে থাকতাম দিগন্ত পানে। এক অন্তহীন নিঃসঙ্গতা কুড়ে কুড়ে খেতো আমাকে। শুধু জানতে ইচ্ছে করতো- 'রাজিব, তুই ভালো আছিস তো?'

তারপরে খুব দ্রুত কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম রাজিবের মাঝে। একদিন দেখলাম দাড়িগুলো পুরোপুরি কামিয়ে ফেলেছে ও। ফর্সা মুখটা মনে হয় আরো ফর্সা হয়ে বেরিয়ে আসলো। অন্য একদিন দেখলাম জিম থেকে বেরিয়ে আসছে ও। তারপর আরেক দিন দেখলাম জেন্টস পার্লারে।

প্রেমে পড়লে মানুষের মন বদলায় শুনেছি। শরীরের চামড়াগুলোও যে প্রলেপ দিয়ে, চেচে মুছে পরিষ্কার করতে হয়- রাজিবকে দেখে সেটা বুঝলাম।

বদলে গেল সময়।
বদলে গেল রাজিব।
আর এক গাল দাড়ি নিয়ে- নিজেকে ভুলে যাবার অন্তহীন প্রয়াসে- আমি ডুব দিলাম সাহিত্যের সাগরে।

প্রায় একটা বছর ওর সাথে আমার আর যোগাযোগ ছিলো না। তখন আমি মাস্টার্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

একদিন সকাল বেলায় নাস্তা করতে যাবো- এমন সময় দেখলাম প্রায় আশি হাত দূরে এক কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে আছে। তবে অবাক হচ্ছিলাম- কাকতাড়ুয়াটা দেখতে ঠিক মানুষের মতোই। পরনে শার্ট, প্যান্ট এবং পায়ে জুতো পর্যন্ত। চিকন একটা বাঁশের  উপর মানুষের মাথার মতো কি একটা গোল যেন বসানো ছিল। কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম- এটা কাকতাড়ুয়া নয়। এ যে আমাদের সেই রাজিব! কী হাল হয়েছে ওর! নিজের চোখকে বিশ্বাস করা খুব কঠিন মনে হচ্ছিল। আমি রাজিবের হাতটা ধরলাম। তারপর বললাম, “তোর এই অবস্থা কেন? এমন তো ছিলি না তুই? শুকিয়ে একেবারে বাঁশের চেয়ে চিকন হয়ে গেছিস।”

ও কিছু বলল না। হয়তো ও কিছু বলতে পারলো না। আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে খুব দ্রুত সরে গেল ওখান থেকে। আমি কোনো হিসেব মিলাতে পারলাম না। জীবনের কোনো হিসেবই মিলে না গাণিতিক নিয়মে।


নেশাগ্রস্ত রাজিব


এর ঠিক আঠারো দিনের মাথায় একটা চিঠি পেলাম রাজিবের।

ইমরান,

আমি শেষ হয়ে গেছি। এভাবে শেষ হয়ে যাবো কখনো ভাবি নি রে। একটা ছোটো গল্পের মতো হঠাৎ শুরু আমার জীবনের। আর ছোটো গল্পের মতো তার হঠাৎ-ই শেষ।


যে সত্যটা আমি কাউকে বলি নি, এমনকি তোকেও নয়- আজ সেটা তোর কাছে বলবো। আমি এক হত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আমাদের  ঘরটা ছিলো ছনের। ছোটোবেলায় দেখতাম যখনই কোনো ঝড় হতো- আমাদের মনের সাথে সাথে ঘরটাও কাঁপতো থর থর করে। ক্লাশ সেভেনে পড়ার সময় জসিম উদদীন এর একটা কবিতা নকল করে কয়েকটি চরন লিখেছিলাম এরকম-


তুমি যাবে, যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে

আমাদের কুঁড়ে ঘরে
যে ঘরে বৃষ্টি এলেই বৃষ্টি পড়ে।

এই সীমাহীন দারিদ্রতাই আমাকে দূরে রাখতো সবার কাছ থেকে। তাই ইচ্ছে করেই  মেয়েদের সাথে মিশতাম না। আমার কেবলি মনে হতো অর্থ (টাকা) ছাড়া কোনো কিছুরই অর্থ নেই।


হার না মানা এক স্বভাব ছিল আমার। তাই শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পড়াশোনা ছাড়িনি। সেই ক্লাশ

সিক্স থেকে টিউশন শুরু করি। যখন ক্লাশ নাইনে পড়তাম তখনই পড়াতাম ক্লাশ টেন-এর এক ছেলেকে। রিয়েলি, যথেষ্ট মেধাবী ছিলাম আমি।

তোর মতো আমারও একটা মন ছিল। কিন্তু সেই মনের দরজায় মস্ত এক তালা ঝুলিয়েছিলাম। কেননা, কারো ভালোবাসা পাবার যোগ্য আমি ছিলাম না। এই যান্ত্রিক পৃথিবীতে ভালোবাসা পেতে কিংবা দিতে বুক বোঝাই ভালোবাসা নয়, লাগে পকেট বোঝাই টাকা। কিন্তু নিজের এই অক্ষমতা, অযোগ্যতা কিংবা দারিদ্রতা কারও কাছে প্রকাশ করতে চাইতাম না আমি। তাই কৌশলে শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। সেটাই বোধহয় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার জীবনে।


কারো ভালোবাসা পাবো না বলেই হয়তো ভালোবাসার বিরুদ্ধে লেখালেখি করে মনের রাগ ঝাড়তাম আমি।

তারপরেও- আমার একটা মন ছিল।
সেই মনটা মাঝে মাঝেই সন্তানশূন্য মায়ের বুকের মতো খা- খা করতো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য।

তাই ছয়টি বছর পরেও যখন দেখলাম- একটা মেয়ে এখনো আমার পথ চেয়ে বসে আছে তখন সেই পথে হাটা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলো না। যদিও জানতাম এই পথটা মোটেই মসৃণ নয়। ভীষণ বন্ধুর। দুর্গম। বড়ো সচেতনভাবে ভুল জায়গায় ফুল দিলাম আমি।


ভালোবাসা পেয়ে বুঝলাম- ভালোবাসা ভালো নয়।

টানা একটা বছর ভালোবাসার জলে সাঁতার কেটে দেখলাম- এর কোনো কিনারা নেই। এ যে সীমাহীন। তাই তীরে তরী ভিড়লো না আমার।

ওরা যে এতো বড়লোক- এটা ছিলো অকল্পনীয়। ভেবেছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হবে ও। কিন্তু দেখলাম- তা নয়। ধনীর দুলালী। ওর বাবা মা’র ধারনা- আমি রিয়াকে পটিয়েছি রাজ্য ও রাজকন্যা একসাথে পাবার আশায়।


ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল ভীষণ বড়লোক এক ছেলের সাথে। ছেলেটা জব করে জাতিসংঘের সচিবালয়ে। স্যালারি বাংলাদেশি টাকায় চার লক্ষ ত্রিশ হাজার। এমনটা হয়েছিল কারণ রিয়াও তো কম সুন্দরী নয়। এমন সুন্দর একটা মেয়ে ও! ওর পাশে ঐ লোকটা আর টাকার পাহাড়টা চমৎকার মানায়।


ভালোবাসা তাই মুখ থুবড়ে পড়ে।


আমি নিজেকে সরিয়ে নেই।  আমার মতো অযোগ্য, অপদার্থটাকে ওর পাশে একটুও মানায় না।


বিয়ে হয়ে গেল রিয়ার। শুনেছি অনেক নাকি কেঁদেছিল সেদিন। একমাস পরে নাকি দেখা গেছে হাজব্যান্ডের সাথে হাসতে হাসতে শপিং করছে ও। নিজেকে তাহলে বদলাতে পেরেছিল রিয়া? অবাক লাগেনি আমার।


কিন্তু এই একটা বছরের অন্তহীন ভালোবাসা, কথা বলা, স্বপ্ন দেখা- সবই সারাটাক্ষন তাড়িয়ে বেড়াতো আমাকে।


ওকে ভুলে যাবার অদম্য বাসনা থেকে প্রথমে বই পড়া শুরু করি। দেখি- প্রতিটি বইয়ের প্রতিটি পাতা ওর মুখ হয়ে ভেসে উঠছে আমার সামনে।


তারপর বই ছেড়ে ধরি সিগারেট। সিগারেটের প্রতিটি টানে, ধোঁয়ার মাঝেও দেখি ওর সেই হাসি হাসি মুখখানা।


মনে হতো- যদি স্মৃতি শক্তি লোপ না পায়- তাহলে ওকে কোনোদিন ভুলতে পারবো না আমি। যতই ভুলে যেতে চাই, ততই মনে পড়ে।


তারপর ধরলাম মদ।

তারপর হেরোইন।

এই ভয়াল মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য ঢুকে গেলাম অপরাধের অন্ধকার জগতে।


রিয়ার এসব কিছুই আর জানবার কথা নয়।


ইতি

রাজিব

চিঠিটা পড়ার পরে দু’চোখ ভিজে গেল আমার।

সেদিন বিকেলেই ওদের গ্রামের বাড়ি যাই আমি। গ্রামের প্রায় সবাই ওকে চিনে। ওদের বাড়ি চিনতে তাই সমস্যা হলো না। সবার মুখে একই কথা শুনলাম- “বড়ো ভালো ছিল ছেলেটা। কেন যে এভাবে নষ্ট হয়ে গেল?”

দেখি সত্যিই একটা ঘর। যার উপরে ছনের চাল। ঘরের সামনে চৌকাঠে বসা মধ্যবয়স্কা এক নারী। ধারনা ভুল হলো না আমার- মহিলাটা রাজিবের মা। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “রাজিব কোথায়? বাসায় নাই?”

মহিলাটির বুকের পাঁজর মনে হয় ভেঙে গেল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো চোখের জল। কোনো শব্দ করলো না। হাতের ইশারায় আমকে সামনে যেতে বলল।

দেখি একটা কবর।
বুঝাই যায় কবরটা একেবারে নতুন। হ্যা, দু’দিন আগের। এই তো দু’দিন আগে- ক্রস ফায়ারে মারা গেছে রাজিব।

একটা কবরের সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ি আমি। পুরো পৃথিবীটা ঘোলাটে হয়ে আসে পশ্চিম আকাশের শেষাশেষি সূর্যটা ক্রমশ ম্লান হচ্ছে। অস্ত যাবে এখনি। সেই অস্তায়মান সূর্যের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে হাস্যোজ্জ্বল একটা মুখ। মুখটা রাজিবের। দাড়ি শোভিত। ভীষণ পবিত্র। কানের কাছে শুনতে পাই ভরাট কন্ঠে আবৃত্তি করছে ও-

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে
ভালোবাসার সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দেই।
ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেই-
শত শত প্রেমিকের রক্তে গড়া
ভালোবাসার টুইন টাউয়ার।

তারপর হবো ইতিহাস।

হবো ইতিহাস।

সূর্যটা হারিয়ে যায়। আমি হাটু গেড়ে বসে থাকি। নিশ্চল। নিথর।

পরের দিন।

কলেজের মাঠটায় দাঁড়িয়ে থাকি আমি।
ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া একটা গাছের মতো।
নিঃশব্দে।

তাকিয়ে দেখি- সমস্ত কলেজ মাঠটা জুড়ে শত শত তরুণ তরুণী বসা। জোড়ায় জোড়ায়।

কিছুই বদলায়নি।
কিছুই বদলায় না।
কেউ বেঁচে থাকলে।
কিংবা কেউ মরে গেলেও ......

লেখা- ওয়াদুদ খান
সদরপুর, ফরিদপুর 
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪